গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগে চরম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা। তাদের মতে, সরকার গ্যাসের দাম আবারো বাড়ালে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যবসা-বাণিজ্য। বন্ধ হবে অনেক শিল্পকারখানা। ফলে বেকার হবে অসংখ্য শ্রমিক, কমে যাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ। যা মধ্য আয়ের অর্থনৈতিক দেশ গড়ার পথে প্রধান অন্তরায় হিসাবে দেখা দিতে পারে।
এছাড়া এমনিতেই মূল্যস্ফীতির যাতাকলে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ, তার মধ্যে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলে জীবনযাত্রার ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। এই অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর আগে নতুন করে ভাবতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সূত্র জানায়, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো আবাসিক দুই চুলা ৬৫০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা, এক চুলা ৬০০ থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা আর প্রতি ঘনমিটার সাত টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা ৮০ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে। শিল্পকারখানার ক্যাপটিভ পাওয়ারে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম আট টাকা ৩৬ পয়সা থেকে ১৯ টাকা ২৬ পয়সা, যানবাহনের সিএনজি ৩৫ থেকে ৫৮ টাকা করার প্রস্তাব করেছে।
এছাড়া বিদ্যুতের প্রতি ঘনমিটার দুই টাকা ৮২ পয়সা থেকে চার টাকা ৬০ পয়সা, শিল্প বয়লারে ছয় টাকা ৭৪ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৪৫ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সম্প্রতি গ্যাস বৃদ্ধির বিষয় নিয়ে এক গণশুনানির আয়োজন করে বিইআরসি। যে শুনানিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেনি সরকারি এ সংস্থা। তারপরও সব পক্ষকে উপেক্ষা করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির চিন্তা জনস্বার্থবিরোধী হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, এর ফলে বাংলাদেশের মধ্য আয়ের দেশে যাওয়ার পথে এটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মতে প্রস্তাবিত এই মূল্যবৃদ্ধি গৃহীত হলে পরিবহন খরচ, বাণিজ্য ক্ষেত্রে উৎপাদন ও আনুষঙ্গিক সব খরচ, বিদ্যুৎ ও সারসহ সকল উৎপাদন খরচ, কৃষিপণ্য এবং সর্বোপরি নিত্যপণ্যের খরচসহ নানাবিধ খরচ বেড়ে যাবে।
সূত্র জানায়, সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে গড়ে ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই আবারো বাড়ছে সব ধরনের গ্যাসের দাম। ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি গড়ে ৮৮ শতাংশ দাম বাড়নোর প্রস্তাবের উপর গণশুনানি হয়।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, প্রস্তাবিত মূল্য কার্যকর করা হলে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস খাতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি মো. আব্দুল কাদের খান বলেন, বিজিএপিএমইএ’র আওতাভুক্ত দেড় হাজার শতভাগ রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ৩০ শতাংশ কারখানায় গ্যাস ব্যবহার করে উৎপাদন করতে হয়। গ্যাসের চাপ কম থাকায় এমনিতেই দিনের বেলা কর্মঘণ্টার সময় শ্রমিকদের কাজে লাগানো যায় না। আবার যখন গ্যাসের চাপ থাকে তখন শ্রমিকদের কাজে লাগাতে হলে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে এমনিতেই কারখানা চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ সমস্যার মধ্যে আবার এর উপর গ্যাসের দাম বাড়ানোটা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়।
এদিকে গ্যাসের দাম বাড়ালে সারা দেশ অচল করে দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে সিএনজি ফিলিং স্টেশনের মালিকরা। এছাড়া গ্যাসের দাম বাড়লে গ্রাহকরা দিশেহারা হয়ে পড়েবে।
তারা বলছে, বর্তমানে দেশে সিএনজি স্টেশন ৫৯০টি এবং রূপান্তরিত গাড়ি তিন লাখ এবং থ্রি হুইলার ৫ লাখ। ২০১৫ সালে প্রতি ইউনিট সিএনজি ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করা হয়। গত ছয় বছরে এর দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ।
এর আগে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ইসতিয়াক আহমদ দাম বৃদ্ধির যুক্তিকতা নিয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোম্পানি থেকে পেট্রোবাংলা গ্যাস কেনে। বেশি দামে গ্যাস কিনে কম দামে বিক্রি করতে হয়। আগে গ্যাস বিক্রিতে ট্যাক্স-ভ্যাট দিতে হতো না। এখন দিতে হবে। তাই কোম্পানিগুলোর ঘাটতি দূর করতে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, এতে দেশীয় সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে এবং হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারকে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।