1. sardardhaka@yahoo.com : adminmoha : Sardar Dhaka
  2. nafij.moon@gmail.com : Nafij Moon : Nafij Moon
  3. rafiqul@mohajog.com : Rafiqul Islam : Rafiqul Islam
  4. sardar@mohajog.com : Shahjahan Sardar : Shahjahan Sardar
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৩৮ পূর্বাহ্ন

কয়েক রকম বাংলাবাজার

মহাযুগ নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭
  • ৩৭৪ বার

ইমদাদুল হক মিলন : কদিন বাদেই বইমেলা। বই-বই গন্ধ বাংলাবাজারে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বই-বাজারের লোকজনের সময় এখন কাটছে তুমুল ব্যস্ততায়। কেমন ছিল এই বইয়ের মুলুকের পুরোনো দিনগুলো?
অনেক দিন পর বাংলাবাজার গিয়েছি। তাও বেশ কয়েক বছর আগে। ইচ্ছে হলো, দেখি ফুটপাতে বইয়ের দোকানগুলো আগের মতো আছে কি না। কলেজিয়েট স্কুলের উল্টোদিককার ফুটপাতে দেখি কিছু দোকান আছে। তবে আগের মতো গল্প-উপন্যাসের কালেকশন নেই। বেশির ভাগই পাঠ্যবই। আগে পাঠ্যবইয়ের তুলনায় গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধ-বিজ্ঞান-ইতিহাস-জীবনী ইত্যাদিই বেশি থাকত। এখন উল্টো হয়ে গেছে। মস্কো থেকে আসা প্রগতি প্রকাশনীর কী অসামান্য সব বই এই ফুটপাতে পড়ে থাকত, কলকাতার বিখ্যাত লেখকদের বই থাকত। সেই সব মহৎ পুরোনো বইয়ের গন্ধে অন্য রকম হয়ে থাকত এখানকার হাওয়া, সেই অবস্থাটা নেই। তবু দোকানগুলো দেখে ভালো লাগল। কত স্মৃতি এই ফুটপাতে আমার। বই দেখছি, দোকানিদের দেখছি। বইয়ের মতো দোকানিরাও বদলে গেছেন। কাউকেই চিনতে পারি না। একজন বৃদ্ধ মানুষ বসে আছেন দেয়ালে হেলান দিয়ে। চুল-দাড়ি সবই সাদা। চোখে নড়বড়ে ফ্রেমের মোটা কাচের চশমা। শরীরে ভাঙন ধরেছে। বসার ভঙ্গি দেখে চিনতে পারলাম। সেই বাহাত্তর-তিয়াত্তর সাল থেকে এভাবেই তাঁকে বসে থাকতে দেখেছি। সামনে ছড়ানো-ছিটানো কত মূল্যবান বই। তিনি উদাস হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন। মুখে পান। বইপ্রেমীরা বই কিনছেন। দামদস্তর নিয়ে তিনি তেমন বাড়াবাড়ি করতেন না। চার আনা-আট আনা লাভ পেলেই বই ছেড়ে দিতেন।

আমার মিনু খালার খুব বই পড়ার অভ্যাস। প্রায়ই দু-চার-পাঁচ টাকা দিয়ে আমাকে বাংলাবাজারে পাঠাতেন। এই ভদ্রলোকের তখন মধ্যবয়স। মোটা মোটা উপন্যাস বেশি বিক্রি করতেন। সস্তায় মিনু খালার জন্য আমি নীহাররঞ্জন-ফাল্গুনীর বই কিনতাম, আশুতোষ যাযাবরের বই কিনতাম। ভদ্রলোক উদাস হয়ে থাকতেন আর সেই ফাঁকে একটা-দুটো বই কোমরের কাছে গুঁজে ফেলতাম। সেগুলো একটু রোগা ধরনের বই। সমরেশ বসুর বিবর ওইভাবে সরিয়েছিলাম।
এত দিন পর সেই মানুষটাকে দেখে খুব ভালো লাগল। দু-এক কথার পরই তিনি আমাকে চিনতে পারলেন। ফোকলা মুখে হাসি ফুটল। কী কও মিয়া, তোমারে চিনুম না? কত বই আমার এখান থিকা মারছ! দুইটা কিনলে একটা মাইরা দিতা।
আমি অবাক। আরে, কোনো দিন তো কিছু বলতেন না!
কী বলুম? ছাত্র মানুষ। বই পড়ার শখ। পয়সা পাইবা কই? বই দুই-চাইরটা ছাত্ররা মারবই। তোমার কারবারটা আমি দেখতাম। কিছু কইতাম না। ভালো আছো, বাবা?
আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। ফুটপাতে বসে থাকা মানুষটিকে হিমালয়ের মতো মনে হয়েছিল।
আমরা থাকতাম জিন্দাবাহার থার্ড লেনে। ষাট-একষট্টি সালের কথা। আমার মায়ের মামাবাড়ি গেন্ডারিয়ায়। মা, বাবা, ভাইবোনদের সঙ্গে গাদাগাদি করে রিকশা কিংবা ঘোড়ার গাড়িতে গেন্ডারিয়া যাচ্ছি। সদরঘাটের উত্তরদিককার মুখ থেকে পুব দিকে ঢুকে গেল রাস্তা। রাস্তার মুখে একটা বটগাছ, ব্যাপ্টিস্ট মিশন, পোস্ট অফিস আর কিছু বইয়ের দোকান। বাংলাবাজার। কী বিস্ময় নিয়ে বইয়ের দোকানগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকেছি!
আমি থাকি বিক্রমপুরে, নানির কাছে। স্কুল ছুটিতে ঢাকায় এসেছিলাম। একা একা ফিরে যাচ্ছি। ক্লাস ফোরের ছাত্র। আব্বা আমাকে লঞ্চে চড়িয়ে দিতে এসেছেন। লঞ্চে এতটা সময় কী করে কাটবে? বাংলাবাজারের ফুটপাত থেকে চার আনা না ছয় আনা দিয়ে আব্বা আমাকে একটা বই কিনে দিলেন—সিন্দাবাদের সাত অভিযান। জীবনের প্রথম গল্পের বই। লঞ্চের পুরো সময়টা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকলাম সেই বইয়ে।
তারপর শুরু হয়েছিল গেন্ডারিয়ার জীবন। লোহারপুল পার হয়ে শ্যামবাজারের ওদিক দিয়ে সদরঘাটে আসতাম। শ্যামবাজারের উল্টো দিকে জমিদারবাড়ির মতো এক বাড়িতে সাইনবোর্ড ঝুলছে, ‘পুঁথিঘর’। আমাদের ব্যাকরণ ও রচনা বইয়ে লেখা থাকত, ‘পুঁথিঘর, চৌমোহনী, নোয়াখালী। আরে, সেই ‘পুঁথিঘর’ দেখছি এইখানে!
মিন্তির মাথায় চাঙারিভর্তি বই যাচ্ছে-আসছে, ঠেলাগাড়িতে করে বই যাচ্ছে, বই আসছে। এত বই কোথায় তৈরি হয়, কোথায় যায়!
জিন্দাবাহারের ওদিকে অনেক প্রেস ছিল। কিছু বড় বড় বইয়ের দোকান ছিল। চকবাজারেও ছিল বেশ বড় একটা বইয়ের বাজার। বেশির ভাগই ধর্মীয় বইয়ের দোকান, পাঠ্যবইয়ের দোকান। গল্প-উপন্যাস-কবিতা-ইতিহাস-প্রবন্ধ—এসবের দোকান ছিল বাংলাবাজারে। পাঠ্যবই ও ধর্মীয় বই তো ছিলই। অর্থাৎ বাংলাবাজারে পাওয়া যেত সব ধরনের বই। প্রেসও ছিল অনেক। শ্রীশদাস লেন, প্যারিদাস রোড, ওদিকে পাটুয়াটুলির গলির ভেতর দিনরাত ঘটাং ঘটাং করে চলছে ট্রেডেল মেশিন, ফ্ল্যাট মেশিন।
এসব ছাড়িয়ে বইয়ের সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে গড়ে উঠল বাংলাবাজারে। স্বাধীনতার আগে, আমার মনে পড়ে কয়েকটি প্রকাশন সংস্থার কথা। আহমেদ পাবলিশিং হাউস, বইঘর, চলন্তিকা, নওরোজ কিতাবিস্তান, মল্লিক ব্রাদার্স, খোশরোজ কিতাব মহল, স্টুডেন্ট ওয়েজ, মাওলা ব্রাদার্স, খান ব্রাদার্স, বুক সোসাইটি…ওদিক দিয়ে যাওয়া-আসার পথে এসব দোকান চোখে পড়ত। রেকভর্তি বই, আলমারিভর্তি বই। মালিক-ম্যানেজার বসে আছেন। দোকানের কর্মচারীরা ব্যস্ত হাতে রেক থেকে বই নামাচ্ছেন, তুলছেন। কেটলিতে করে চা নিয়ে এল অল্প বয়সী একটা ছেলে। মালিক-ম্যানেজারের টেবিলের সামনে বসে আছেন দু-একজন। হয়তো তাঁরা কেউ লেখক। চায়ের সঙ্গে তুমুল হাসিগল্প চলছে।
এ রকম দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি বড় হচ্ছিলাম। বাংলাবাজারের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম স্বাধীনতার পর। জগন্নাথ কলেজে পড়ি। তিয়াত্তর সাল। প্রথম গল্প ছাপা হয়েছে। দিনরাত পাগলের মতো যা মনে আসে লিখি। বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে গিয়ে লেখা দিয়ে আসি। বেশির ভাগই ছাপা হয় না।
বাংলাবাজারে একটা পত্রিকা অফিস ছিল। জোনাকী। মাসিক পত্রিকা। ডাবল ক্রাউন সাইজ। জোনাকীর মালিক-সম্পাদক ছিলেন আবদুল মতিন নামের বিনয়ী একজন মানুষ। তাঁর বইয়ের ব্যবসাও ছিল। বোধ হয় স্কুলের দ্রুত পঠন ধরনের বই ছাপতেন। ৩৮ নম্বর বাংলাবাজারে অফিস। রাস্তা থেকে বেশ ভেতরের দিকে। জোনাকীর অফিসটা আসলে বেশ বড় সাইজের একটা বইয়ের দোকান। সামনের দিকটায় বইপত্রের রেক, ভেতরের দিকটায় পত্রিকার অফিস। উল্টো দিকে মতিন সাহেবের প্রেস। বিশাল মেশিনে বই ছাপা হচ্ছে, পত্রিকা ছাপা হচ্ছে।
জোনাকীর দায়িত্বে ছিলেন আহসান হাবিব নামের এক ভদ্রলোক। তাঁর ছদ্মনাম আহমেদ আনবির। ঢাকা ইউনিভার্সিটির তরুণ শিক্ষক। দেখতে ফুটফুটে সুন্দর, স্মার্ট। থ্রিলার আর ছোটদের জন্য নানা রকমের লেখা লিখতেন। অনুবাদও করতেন। বেশ স্পিডে মোটরসাইকেল চালাতেন। পরে রোকেয়া হলের সামনে মোটরসাইকেল অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। সেসব অনেক পরের কথা।
জোনাকীতে লেখা দিতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে। বুলবুল তখন উঠতি তরুণ গল্পকার। তিনিও গিয়েছিলেন লেখা দিতে। এ পত্রিকার দায়িত্বে থাকা আহসান হাবিব আমাকে একদমই পাত্তা দেননি। ঢাকা ইউনিভার্সিটির লেকচারার, একটা পত্রিকার দায়িত্বে তার ওপর ‘মুক্তধারা’ থেকে বই বেরিয়েছে। আমাকে পাত্তা দেবেন কেন?
‘মুক্তধারা’ যাত্রা শুরু করেছিল কলকাতা থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সময়। স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা, পুঁথিঘরের মালিক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পুঁথিঘরের ব্যাকরণ রচনা-নোটবই ইত্যাদি তো আগের মতো চলছিলই, চিত্তদা বিশালভাবে শুরু করলেন মননশীল বইয়ের প্রকাশনা। একই বাড়িতে ‘পুঁথিঘর’ ও ‘মুক্তধারা’র অফিস। দেশের প্রায় সব লেখকের বই দেদারসে বেরোতে লাগল। কী সুন্দর প্রচ্ছদ, কী সুন্দর ছাপা বাঁধাই। কী যত্নে বেরোচ্ছে একেকটা বই। শ্যামবাজারের ওদিক দিয়ে বাংলাবাজার যাওয়ার সময় তাকিয়ে তাকিয়ে ‘মুক্তধারা’র সাইনবোর্ড দেখি। কোনো কোনো লেখককে তত দিনে চিনতে শুরু করেছি। তাঁদের আসা-যাওয়া দেখি। অনেক পরে চিত্তদার সঙ্গে পরিচয় হলো। আমার প্রথম উপন্যাস যাবজ্জীবন বেরোল ‘মুক্তধারা’ থেকে। প্রথম কিশোর উপন্যাস চিতা রহস্য বেরোল।
’৭৯ সালে জার্মানিতে যাওয়ার আগে যাবজ্জীবন দিয়েছিলাম চিত্তদার হাতে। তাঁর সম্পাদনা পরিষদ ছিল। পরিষদ প্রধান আবদুল হাফিজ, প্রাবন্ধিক। আমার উপন্যাস নির্বাচিত হলো। খুব শখ প্রথম উপন্যাসের প্রচ্ছদ করবেন কাইয়ুম চৌধুরী। চিত্তদা রাজি হলেন। দুই বছর পর জার্মানি থেকে ফিরে দেখি বই বেরোয়নি। কী কারণ? কাইয়ুম ভাই কাভার এঁকে দেননি। আমি কাইয়ুম ভাইয়ের কাছে দৌড়াদৌড়ি করে আরও বছরখানেক পর কাভার পেয়েছিলাম।
তার আগে ’৭৭ সালে আমার প্রথম গল্পের বই ভালোবাসার গল্প বেরিয়ে গেছে। ‘বুক সোসাইটি’ থেকে। জার্মানিতে থাকা অবস্থায় ওখান থেকেই বেরিয়েছে দ্বিতীয় গল্পের বই নিরন্নের কাল।
তখন পশ্চিমবঙ্গের বইয়ের খুবই রমরমা অবস্থা। বাংলাবাজারের কোনো কোনো প্রকাশক নিউজপ্রিন্টে অবিরাম ছেপে যাচ্ছেন নীহাররঞ্জন, ফাল্গুনী, আশুতোষ, নিমাই ভট্টাচার্যের বই। সমরেশ বসুরও কোনো কোনো বই ছাপা হচ্ছে। কোনো কোনো বইয়ের দোকান ও ফুটপাতভর্তি ওসব লেখকের বই। বাংলাদেশি লেখকদের বই ছাপছে মুক্তধারা, নওরোজ কিতাবিস্তান, স্টুডেন্ট ওয়েজ, মাওলা ব্রাদার্স বা খান ব্রাদার্স। বুক সোসাইটি তো ছাপছেই। তবে বিক্রিবাট্টা সুবিধার না।
বাংলাবাজার বদলাতে লাগল আশি-একাশি সালের দিকে।

বাংলাবাজারের স্বর্ণযুগ গেছে বছর পঁচিশেক—১৯৮০ থেকে ২০০৫। তখন প্রতিমাসেই লেখকদের বই বেরোচ্ছে। উপন্যাস সবচেয়ে বেশি। গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-ছোটদের সাহিত্য-সায়েন্স ফিকশন-মুক্তিযুদ্ধের বই। বাংলাবাজারের বিভিন্ন দোকানে বসে আড্ডা দিতে দিতে দেখছি মফস্বল থেকে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে বই বিক্রেতারা আসছেন লিস্ট নিয়ে। এই বই, ওই বই
আমার ও রাধা ও কৃষ্ণ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি দিয়ে গিয়েছিলাম শিল্পী মাসুক হেলালের কাছে। মাসুক এখন প্রথম আলোয় কর্মরত। আমি জার্মানিতে, এদিকে মাসুক আমার পাণ্ডুলিপি নিয়ে এই প্রকাশক ওই প্রকাশক করছে, কেউ ছাপছেন না। সেই বই ছাপা হলো বিরাশি না তিরাশি সালে। তাও কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক ছাপলেন না, আমাকে পছন্দ করতেন একজন বাইন্ডার, তিনি একটা প্রকাশনা সংস্থা খুলে বইটা ছাপলেন। বাইন্ডার থেকে প্রকাশক হয়েছেন, প্রথম বই ছেপেছেন, জুমার দিন মসজিদে বই নিয়ে গেছেন, শুভকাজ শুরু করেছেন, মিলাদ পড়াবেন, ও রাধা ও কৃষ্ণ নাম দেখে ইমাম সাহেব মিলাদ পড়ালেন না। ভদ্রলোককে ধমকে বিদায় করলেন। তবে মাস ছয়েকের মধ্যে সোয়া দুই হাজারের এডিশন শেষ হয়ে গেছে দেখে ভদ্রলোক খুব খুশি।
আমি তখন সারা দিন পড়ে থাকি বাংলাবাজারে। নওরোজ কিতাবিস্তান আরেকটি সহপ্রতিষ্ঠান করেছে ‘নওরোজ সাহিত্য সংসদ’। ইফতেখার রসুল জর্জ একই দোকানে বসে দুটো প্রতিষ্ঠান চালান। জর্জ ভাই আমাকে খুবই পছন্দ করেন। প্রায় সারা দিন ওখানে আড্ডা দিই। চা-শিঙাড়া খাই, আমিত্তি খাই। একটা-দুটো করে বই বেরোতে লাগল। জর্জ ভাইই ছাপলেন কালোঘোড়া, পরাধীনতা। ধীরে ধীরে প্রকাশকেরা আমাকে চিনছেন। ‘স্টুডেন্ট ওয়েজ’ থেকে বই বেরোল, ‘বিউটি বুক হাউস’ থেকে বেরোল। পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের ঠেলেঠুলে সরিয়ে নিজের একটু একটু জায়গা হচ্ছিল আমার।
’৮৫ সালের দিকে অবস্থা আরও বদলাল। আমেরিকা থেকে ফিরে হু‘মায়ূন ভাই (হুবমায়ূন আহমেদ) নতুন করে লিখতে শুরু করলেন। প্রথম দুটো বই থেকেই তিনি জনপ্রিয়। বিটিভিতে এইসব দিনরাত্রি শুরু হওয়ার পর তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গ স্পর্শ করতে লাগল।
তত দিনে এক ঝাঁক তরুণ প্রকাশক এসে গেছেন প্রকাশনায়। পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে প্রকাশনার জগৎটাকে আমূল বদলে দিলেন তাঁরা।
তাঁদের কয়েকজনের কথা বলি।
জর্জ ভাইয়ের দোকানের আড্ডা থেকে মাঝে মাঝে হামিদুল ইসলামের ‘বিউটি বুক হাউস’-এ গিয়েও আড্ডা দিতাম। এই দুটো দোকানই রাস্তার সঙ্গে। তারপর ঢুকে গেলাম ভেতর দিকে। আড্ডা শুরু হলো ‘বিদ্যা প্রকাশ’-এ। ‘বিদ্যা প্রকাশ’-এর মজিবুর রহমান খোকার সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হলো।
তার আগে আরেকজনের কথা বলি। এই যুবকের নাম ফরিদ আহমেদ। সে প্রকাশনা সংস্থা করবে। পেপারব্যাক বের করবে। আমি তার প্রকাশনার নাম দিলাম ‘অধুনা’। ধানমন্ডি চার নম্বর রোডের কোনায় ছোট্ট একটা বিল্ডিংয়ের দোতলায় একটাই রুম। ‘অধুনা’র অফিস। এই ‘অধুনা’ রেখেই ফরিদ তৈরি করল আরেক প্রকাশনা ‘সময়’ প্রকাশন। শিশু একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে গেছি, শিশু সাহিত্যের বিখ্যাত আমীরুল ইসলাম ফরিদের হয়ে আমাকে ধরল, ‘সময় প্রকাশন’ যাত্রা শুরু করতে চায় আমার বই দিয়ে। ওখান থেকেই নিয়ে গেল ফরিদের আজিমপুরের বাসায়। পাঁচ হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিল। বইয়ের জন্য জীবনে ওই আমার প্রথম অ্যাডভান্স। সম্পর্ক উপন্যাসটি লিখে দিলাম। যাত্রা শুরু করল ‘সময় প্রকাশন’।
‘বিদ্যা প্রকাশ’ আমার দুটো বই বের করল। অভিমান পর্ব আর দিনগুলি। বাংলাদেশে প্রথম লেমিনেশন করা কাভার। রোজ আড্ডা দিই খোকা ভাইয়ের ওখানে। পরিচয় হয় মনিরের সঙ্গে, বাবুলের সঙ্গে, বাহারের সঙ্গে। সেলিম ভাইও আসেন। তাঁকে চিনি গেন্ডারিয়া থেকে। আমরা একই বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। মনিরের পুরো নাম মনিরুল হক। ‘তাজমহল বুক ডিপো’র মালিকের ছেলে। ওদের প্রকাশনা থেকে নিউজপ্রিন্টের নানা রকমের বাজার চলতি বই বেরোয়। মনির আসতে চাইছেন গল্প উপন্যাসের জগতে। পরির তিন প্রেমিক নামে বই লিখে দিলাম, যা কিছু নামে বই দিলাম। ‘তাজমহল বুক ডিপো’ থেকে বেরোল। তারপরই নতুন নামে শুরু করলেন মনির। মনিরের সেই প্রকাশন সংস্থা আজকের বিখ্যাত ‘অনন্যা’ প্রকাশনী।
বাবুলের বাবার বইয়ের দোকানের নাম ‘আফসার ব্রাদার্স’। বাবুলের পুরো নাম আফসারুল হুদা, সে-ও মনিরের মতো করেই শুরু করল। তাঁকেও বই দিলাম। সেলিম ভাই শুরু করলেন ‘কাকলী’ প্রকাশনী। ‘বিশ্বসাহিত্য ভবন’ তোফাজ্জলের, সে-ও এল এই লাইনে। মিনু ভাইয়ের পুরো নাম আলতাফ হোসেন। প্রকাশনার নাম ‘পার্ল পাবলিকেশন্স’। তিনি ভারতীয় বইয়ের আমদানিকারক ছিলেন। মিনু ভাইও শুরু করলেন প্রকাশনা। আলমগীর রহমানের ‘অবসর’ আর ‘প্রতীক’ প্রকাশনা হয়ে উঠল রুচি স্নিগ্ধ প্রকাশনা সংস্থা।
মিনু ভাই ও বাবুল দুজনেই অকালে চলে গেছেন। ‘পার্ল পাবলিকেশন্স’ এখন মিনু ভাইয়ের প্রিয় ভাগনে তুহিন পরিচালনা করে। বেশ নামকরা প্রতিষ্ঠান।
বাহারের কথা একটু বিশেষভাবে বলতে হয়। তাঁর পুরো নাম নজরুল ইসলাম বাহার। প্রকাশনার নাম ‘শিখা’ প্রকাশনী। মনির ও বাবুলের একটু পর সে শুরু করেছিল। আমার ভালোবাসার সুখ দুঃখ বইটি বাংলা একাডেমির ২৮ দিনের মেলায় ৬৫ হাজার কপি বিক্রি করেছিল। ’৯৩ সালের কথা।
ওসমান গনি, আমাদের প্রিয় গনি ভাই আর মিলন নাথ দুই বন্ধু মিলে শুরু করেছিলেন ‘অনুপম’ প্রকাশনী। পরে দুজন আলাদা হয়ে করলেন দুই প্রতিষ্ঠান। ‘অনুপম’ থাকল মিলন নাথের, গনি ভাই করলেন ‘আগামী’। ‘আগামী’ এখন বিশাল প্রতিষ্ঠান।
তারপর হলো ‘অন্যপ্রকাশ’। প্রকাশনা জগতের চেহারা অনেকখানি বদলে গেছে তত দিনে। নব্বইয়ের দশকে এই তরুণ প্রকাশকেরা আমাদের প্রকাশনা জগৎটাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। সঙ্গে পুরোনো প্রকাশকেরা তো ছিলেনই। ইউপিএল, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, এ রকম আরও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। নতুন-পুরোনো প্রকাশক মিলে আমাদের প্রকাশনা জগৎ বিশাল হয়ে উঠল।
বাংলাবাজারের স্বর্ণযুগ গেছে বছর পঁচিশেক—১৯৮০ থেকে ২০০৫। তখন প্রতিমাসেই লেখকদের বই বেরোচ্ছে। উপন্যাস সবচেয়ে বেশি। গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-ছোটদের সাহিত্য-সায়েন্স ফিকশন-মুক্তিযুদ্ধের বই। বাংলাবাজারের বিভিন্ন দোকানে বসে আড্ডা দিতে দিতে দেখছি মফস্বল থেকে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে বই বিক্রেতারা আসছেন লিস্ট নিয়ে। এই বই, ওই বই। দোকানের কর্মচারীরা রেক থেকে বই নামিয়ে কূল পাচ্ছেন না। কী বিক্রি একেকটা দোকানে! বাইন্ডিংখানা থেকে ভ্যানে করে বই আসছে, বই যাচ্ছে। লোকজনের আনাগোনায় গমগম করছে বাংলাবাজার। বছরের শুরুতে, পাঠ্যবই বাজারে আসার সময় ওদিকটায় হাঁটাচলাই করা যেত না। অন্য সময়ও চেহারা প্রায় ও রকম। ক্রেতা আসছেই, বই বিক্রি হচ্ছেই। একটা সময়ে প্রতিমাসে একটা করে চার-পাঁচ ফর্মার বই লিখতাম আমি। বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি। বছরে দুটো-তিনটা, পাঁচটা এডিশন। প্রকাশকদের মুখ উজ্জ্বল। হুেমায়ূন ভাইয়ের বই পেলে প্রকাশক বড়লোক। দিনে দিনে সেই অবস্থা বদলে গেল। আমাদের প্রকাশনা হয়ে উঠল বাংলা একাডেমি মেলাকেন্দ্রিক। সারা বছরে বই বলতে গেলে প্রকাশকেরা ছাপেনই না। হুড়োহুড়ি শুরু করেন নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে। একসঙ্গে চাপ পড়ে লেখকদের ওপর, প্রচ্ছদশিল্পী আর কম্পোজিটরদের ওপর, প্রেস আর বাইন্ডিংখানায়। বাইন্ডিংখানায় থেকে বই পাকারই সময় পায় না। কাঁচা নড়বড়ে বই চলে আসে বাজারে। ওই এক মাসের বই বিক্রিতে সারা বছরের ব্যবসা নাকি হয়ে যায় কোনো কোনো প্রকাশকের।
কয়েকটি খুবই উল্লেখযোগ্য প্রকাশন সংস্থার কথা লেখার শেষ দিকে এসে বলছি। যেমন ‘ঐতিহ্য’ যেমন ‘পাঠক সমাবেশ’। এই দুটো সংস্থা আলমগীর ভাইয়ের ‘অবসর’ আর ‘প্রতীক’ প্রকাশনীর মতো, মাজহারুল ইসলামের ‘অন্যপ্রকাশ’-এর মতো চমৎকার প্রোডাকশন করছে বইয়ের। ‘পাঞ্জেরী’ করছে শিশু-কিশোরদের মনকাড়া সব বই। আর মাত্র কয়েক বছর আগে প্রকাশনায় আসা ‘প্রথমা’ প্রায় প্রতিমাসে বই বের করছে। ‘প্রথমা’র মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইগুলো অতুলনীয়, আত্মজীবনীর বইগুলো অতুলনীয়।
শুধু বাংলা একাডেমি বইমেলা উপলক্ষে বই বের করার লক্ষণটা খুবই খারাপ। এই অবস্থা থেকে অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াতে হবে প্রকাশকদের। বাংলাবাজারটাকে ফিরিয়ে নিতে হবে তার আগের ঐতিহ্যে, আগের সুসময়ে।

এক নজরে বাংলাবাজার
ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো এলাকার একটি হলো বাংলাবাজার। এ এলাকার অস্তিত্ব ছিল মোগল আমলেরও আগ থেকে। তখন থেকেই মূলত এটি ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। বাংলাবাজারে এখন বাংলাদেশি বইয়ের বৃহত্তম মার্কেট। দেশের প্রকাশনা ব্যবসা আবর্তিত হচ্ছে বাংলাবাজারকে ঘিরে। পাঠ্যবইসহ অন্য অনেক ধরনের বই বের হয় এখান থেকে। বাংলাদেশের বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অফিসও বাংলাবাজারে। সূত্র: উইকিপিডিয়া

এ জাতীয় আরো সংবাদ
© All rights reserved © 2023 Mohajog