প্রায় ৯৪ বছর আগে মারা যান মহান বিপ্লবী এবং কমিউনিস্ট রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। কিন্তু মস্কোর রেড স্কয়ারের একটি মুসোলিয়ামে লেনিনের মমি করা মৃতদেহ আজও প্রদর্শিত হচ্ছে। যদিও লেনিনের মরদেহের ভবিষ্যৎ কী হবে, তাকে সমাধিস্থ করা হবে কিনা এমন প্রশ্ন রাশিয়ায় নিয়মিতই শোনা যায়। কিন্তু প্রদর্শনী থেকে তার মরদেহ সরানোর প্রশ্নে রুশ কর্তৃপক্ষ বরাবর উদাসীনতা দেখিয়ে আসছে।
মহান এই বিপ্লবী নেতার মমি করা মৃতদেহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হল-
১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন বলশেভিক বিপ্লবের মহানায়ক ভ্লাদিমির লেনিন। মারা যাওয়ার পর তৎকালীন সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ চাইল তার জন্য একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে।
স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য শিল্পী নিয়োগের জন্য একটি প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়। এ প্রতিযোগিতায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম খ্যাতনামা স্থপতি আলেক্সেই শ্যুসেভ বিজয়ী হন। দীর্ঘ ছয় বছরের চেষ্টায় ১৯৩০ সালে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ শেষ করেন শ্যুসেভ। ঠিক ক্রেমলিন ওয়ালের পাশেই অবস্থিত এই স্মৃতিসৌধটির একটি অংশ ১৯৪৫ সালে পুনঃনির্মাণ করা হয়। যাতে রেড স্কয়ারের প্যারেডের সময় সোভিয়েত নেতারা সেখানে দাঁড়াতে পারেন।
শ্যুসেভের পরিকল্পনা অনুযায়ী লেনিনের স্মৃতিসৌধ বড় ধরনের মেরামত ছাড়াই গত ৯৪ বছর ধরে টিকে আছে। এটি ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত অন্যতম স্মৃতিসৌধ হিসেবে স্বীকৃত। রেড স্কয়ারের এ সমাধিতে গত শতকের বিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে শায়িত আছে লেনিনের মমি করা মৃতদেহ।
প্রথমদিকে তার মরদেহ আসলে অস্থায়ীভাবে প্রদর্শনের কথা ছিল। কারণ মৃত্যুর আগে লেনিন নিজেই তার মরদেহ সমাধিস্থ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত নেতারা তার মরদেহ সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন এবং তার স্মৃতিসৌধকে একটি বৃহৎ সোভিয়েত প্রতীকে পরিণত করেন।
এই দীর্ঘকাল ধরে লেনিনের লাশের সংরক্ষণ ছিল রাশিয়ার জন্য একটি বৈজ্ঞানিক চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে দেশটির কয়েক প্রজন্মের গবেষক ও বিজ্ঞানীরা নিয়োজিত রয়েছেন। এই সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার দায়িত্বে রয়েছে মস্কোর ইন্সটিটিউট অব মেডিসিনাল অ্যান্ড অ্যারোমেটিক প্লান্টসের বিজ্ঞানীদের একটি দল।
এই রুশ বিশেষজ্ঞরা বহু দেশের নেতার মরদেহ মমি করার বিষয়ে সহায়তা করেছেন। যেমন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম ইল সুং, ১৯৬৯ সালে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হো চি মিন, ১৯৭৯ সালে অ্যাঙ্গোলার রাষ্ট্রপতি আগোস্তিনো নেটো সহ আরও অনেকের মরদেহ সংরক্ষণের জন্য কাজ করেছেন তারা।
প্রত্যেক সপ্তাহেই বিজ্ঞানীরা লেনিনের মরদেহটিকে পরীক্ষা করে দেখেন। স্মৃতিসৌধের ভেতর একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও আদ্রতায় সেটি সংরক্ষিত রয়েছে। মমিটি বিশেষ একটি কাচের ঘরে রাখা হয়েছে, যা ব্যাকটেরিয়া এবং পচে যাওয়া ও শুকিয়ে যাওয়া থেকে সেটিকে রক্ষা করে।
লেনিনের লাশকে মমি করার প্রযুক্তিটি রাশিয়ার একটি রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার বিষয়। কোনো বিজ্ঞানীই এ গোপনীয়তা নিয়ে মুখ খোলেন না। তবে ওই বিজ্ঞানী দলের একজন পাভেল ফোমেঙ্কো ২০১১ সালে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম ইল সাংয়ের মৃত্যুর পর মমি করার প্রক্রিয়া ফাঁস করে দেন।
মমি করার প্রক্রিয়ার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, মমি করার জন্য প্রথমে আমরা লাশের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফেলে দিই। এরপর এক ধরনের দ্রবণ দিয়ে শিরা-উপশিরাগুলো পূর্ণ করি এবং মাংস থেকে সব রক্ত বের করে ফেলি।’ তিনি বলেন, ‘তারপর লাশটি সাদা কাপড়ের ফাল দিয়ে জড়িয়ে মলমের মতো দ্রবণপূর্ণ একটি গ্লাসের বাথটাবে রাখা হয়। কক্ষের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা রক্ষা করা হয়। এরপর শরীরের ভেতরে থাকা পানির জায়গায় ওই দ্রবণ পূর্ণ হয়। এ প্রক্রিয়া চলে ছয় মাস ধরে।’
এদিকে গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই লেনিনের লাশ কবর দেয়া নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকে। অনেকেই মনে করেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বলশেভিক নেতার লাশ সংরক্ষণ করা বা শেষকৃত্য না করে জনসমক্ষে প্রদর্শন কোনো কাজের কথা নয়। আবার যারা মুসোলিয়ামের পক্ষে, তারা বলেন, মুসোলিয়ামের যে জায়গায় দেহ রাখা হয়েছে, সেই জায়গাটি মাটির নিচেই। সুতরাং কবরের নিয়ম অনুযায়ী কোনো রকমের নিয়মভঙ্গ করা হয়নি। সমাজের একাংশের মতে, যারা কমিউনিজমের আদর্শে বিশ্বাসী, তাদের কাছে লেনিনকে কবর দেয়ার প্রশ্ন খুবই বেদনাদায়ক।