1. sardardhaka@yahoo.com : adminmoha : Sardar Dhaka
  2. nafij.moon@gmail.com : Nafij Moon : Nafij Moon
  3. rafiqul@mohajog.com : Rafiqul Islam : Rafiqul Islam
  4. sardar@mohajog.com : Shahjahan Sardar : Shahjahan Sardar
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৩৯ পূর্বাহ্ন

‘ম্যান, আই ডিড সামথিং রিয়েলি কুল’

মহাযুগ নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৭
  • ৩৫৯ বার

সত্যি বলছি আমি দেখেছি তাকে। মাসুদ রানার একটা গল্পে পড়েছিলাম একটা বুলেট তার হৃদপিণ্ডে গিয়ে বিঁধে।

কিন্তু সে মারা যায় না, কারণ বুলেটটি তার হৃদপিণ্ডের ইন্টারভেন্ট্রিকুলার সেপটামে বিঁধে ছিল, কোনো মেজর ব্লিডিং ছাড়াই রানা সেবার বেঁচে যায়। গত ২৪ অক্টোবর যে ছেলেটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয় তাকে মাসুদ রানার ছোট ভাই বললে ভুল বলা হবে না।

ডিউটি করছি ঢাকা মেডিক্যাল ক্যাজুয়ালটিতে। টানা ২৪ ঘণ্টা ডিউটির মাত্র সাড়ে ৫ ঘণ্টা গেছে। দুপুর দেড়টার একটু পরে হুরমুর করে সে ঢুকে ক্যাজুয়ালটিতে, তার পরিচয় সে একজন কন্সট্রাকশন ওয়ার্কার। সঙ্গে একগাদা লোক। কিন্তু যে নায়কোচিতভাবে তার এন্ট্রি হবার কথা ছিল তা হলো না। সে এসেছে একটা ট্রলির ওপর শুয়ে। ৪ ফুট লম্বা, দেড় ইঞ্চি ব্যাসের একটা ৬ সুতার রড তার বুকের মাঝ দিয়ে ঢুকে পিঠের ডান দিক দিয়ে বের হয়ে গেছে। সে তখনো শ্বাস নিচ্ছে, কথা বলছে।

সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পুরো টিমের ইফোর্ট তার ওপর গিয়ে পরে। সব ধরনের প্রটোকল-গাইডলাইন মেনে তাকে ওটির জন্য রেডি করতে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠে। সারপ্রাইজিংলি ভাইটালস সব নরমাল, তার মানে কোনো মেজর ইন্টারনাল ব্লিডিং নাই অথবা রডের প্রেশার ইফেক্টের কারনে বন্ধ আছে।

ঘটনা থেকে জানা যায়, মাহমুদুল মিরপুরের একটা কন্সট্রাকশন সাইটে দোতালা থেকে সরাসরি খোলা রডের ওপর পরে। তার সহকর্মীরা রড কেটে তাকে রডসহ নিয়ে আসে। বাইরে থেকে থেকে যতটুকু এসেস করা হয় তাতে দেখা যায় যিফিস্টার্নামের বাম দিক থেকে আড়াআড়িভাবে ডানে ওপরের দিকে ঢুকে পিছনে ৮ম রিব ভেঙে বের হয়ে গেছে, এবং ঢোকার সময় পড়নের গেঞ্জি ভিতরে নিয়ে গেছে। পরে অবশ্য কাপড় সরাতে গিয়ে আমাদের ভুল ভাঙে, যে রড পিছন থেকে ঢুকে সামনে দিয়ে বের হয়েছে।

হতে পারে লেফট লোব লিভার ইনজুরি, হার্ট ইঞ্জুরি, এওর্টা, ভেনাক্যাভা, ডায়াফ্রাম, স্টমাক, ইসোফেগাস, লাংস ইনজুরি। অতি ধ্রুত মৃত্যুর জন্য দায়ী হতে পারে অত্যাধিক ব্লিডিং, নিউমো/হিমো থোরাক্স, এমবোলিজম ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সে দিব্যি শ্বাস নিচ্ছে, ভাইটালস ভালো, অনগোয়িং সিভিয়ার কোন ব্লিডিং ছিল না।

তাকে খুব তাড়াতাড়ি ক্যাজুয়াল্টি ওটি (সিওটি) তে নেওয়া হল। খুব যত্নের সাথে ওটি টেবলে ট্রান্সফার করা হল, রড সহ অপারেটিভ ফিল্ড ওয়াশ দেওয়া হল। মাহামুদ ভাই রাইট থোরাকোটমি ইনসিশন দিয়ে শুরু করলেন। এনেস্থেশিয়ায় ছিলেন তুষার ভাই। আমি আর মাহাবুব ভাই এসিস্টে।

এন্ট্রি এক্সিট ওউন্ডে ইনসিশন বাড়ানোর পরও যখন বিপি ঠিক ছিল তখন আমরা একটু সাহস পেলাম যে এবার রড বের করা যায়। মাহামুদ ভাই দুই ওউন্ডে হাত দিয়ে রডের ওপর প্রেশার রিলিজ করলে আমি আস্তে আস্তে রডটা টেনে বের করলাম। যখন পুরোটা বের হল তখন সবার মাথায় চিন্তা যে এই বোধহয় কোন থ্রোম্বাস সরে গিয়ে ব্লিডিং শুরু হয়। আল্লাহর রহমতে তেমন কিছু হয়নি। তখন সুযোগ মিললো ভিতরে নজর দেবার।

রাইট লাংস লোয়ার লোব পুরো ল্যাসারেটেড (ওপেন নিউমোথোরাক্সের কারনে অক্সিজেন স্যাচুরেশনে কোন প্রব্লেম হয়নি)। ক্লট সরায়ে দেখলাম পেরিকার্ডিয়াল ছিড়ে গেছে, তার ফাক দিয়ে হার্ট বিট করছে। হার্টের বা ডায়াফ্রামের কিছুই হয়নি। এই দুইটার মাঝখান দিয়ে রড ঢুকে লাংস রিব ভেদ করে রডটা বের হয়ে গেছে (বুঝতে হবে মাসুদ রানার ছোট ভাই বলে কথা, হার্ট ডায়াফ্রাম দুজনকেই টেনেছে কিন্তু কাউকে বাধনে জড়ায়নি)।

ওয়াশ দিতে দিতে বিটিং হার্টের ওপর হাত রাখলাম। তখন যে ফিলিংসটা হল সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। ১২ বছরের মেডিকেল জীবনে প্রথমবারের মত মনে হল-‘ম্যান, আই ডিড সামথিং রিয়েলি কুল’।

থোরাসিক সার্জনদের কাছে এগুলো ডালভাত, কিন্তু অন্য যেকোনো ডাক্তারের লাইফে সে মানুষের জীবন্ত হৃদপিন্ড হাত দিয়ে ধরেছে এটা আল্ট্রা রেয়ার ঘটনা। যাই হোক এরপর লাংস রিপেয়ার করে ড্রেন টিউব দিয়ে ক্লোজ করা হল।

আজ সকাল পর্যন্ত রোগী ভালো। কোনো অসুবিধা নেই। তবে ভয়টা ইনফেকশন নিয়ে। রডটায় যে পরিমাণ ময়লা ছিল, সেপসিস এবং এমপায়েমা হবার চান্স আছে অনেক। আমাদের ওটিতে বেশ কিছু ভুল ছিল। অবশ্য ভুলগুলো করার কারণও ছিল। প্রথমত আমরা পেছনটা যতটা এক্সপ্লোর করেছি সামনেরটা ততটা করিনি। আসলে আমাদের মাথায় ছিল এটা ড্যামাজ কন্ট্রোল সার্জারি করবো, পরে রড বের হয়ে যাবার আনন্দে আর কোনো ব্লিডিং না থাকার উত্তেজনায় পটাপট ক্লোজ করে বের হয়ে আসি।

দ্বিতীয়ত ছবি ভাল তোলা হয়নি, ছবি তোলার সময় আমরা প্রিন্সিপাল অনুসরণ না করেই ফকিরের মত ফ্লাস মেরে গেছি, যেকারণে ছবি গুলো কোন পাব্লিকেশনে প্রকাশযোগ্য নয়। তৃতীয়ত, ভিতরে আরো ইভালুয়েট করা উচিত ছিল, কিন্তু মরিস দিয়ে কি থোরাসিক রিট্রাক্টরের কাজ চলে।

যাই হোক, আমার সহকর্মীদের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ আমাকে এই ওটিতে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেবার জন্য। দোয়া করবেন সবাই ছেলেটার জন্য। তার জন্য কোনো আর্থিক সাহায্য লাগবে না, ঠিকাদার নিজ গরজেই সব খরচ দিচ্ছে। ছেলেটাকে ওটি টেবিলে তোলার ঠিক আগ মুহুর্তে তার যে চেহারা হয়েছিল তা আমি অনেকদিন ভুলবো না। সে জানে সে কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাচ্ছে, সে কাদছে নীরবে, এক অনাত্মীয় পরিবেশে। আল্লাহ যেন তার চোখের পানিকে হাসিতে পরিণত করে দেন।

(লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে)

এ জাতীয় আরো সংবাদ
© All rights reserved © 2023 Mohajog