ভারতের বহু বছর ধরে চলা বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিতর্কের নিষ্পত্তি যাতে আদালতের বাইরে করা যায়, তার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন সে দেশের সুপরিচিত হিন্দু ধর্মগুরু রবিশঙ্কর। খবর বিবিসির
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রচ্ছন্ন সমর্থনও তার পেছনে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বুধবার সকালে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে বৈঠক সেরে তিনি অযোধ্যায় গিয়ে পৌঁছেছেন, যেখানে তিনি দু’দিন ধরে বিভিন্ন হিন্দু ও মুসলিম সংগঠনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালাবেন।
তবে বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ দুপক্ষই অন্তত প্রকাশ্যে এই উদ্যোগকে নাকচ করে দিচ্ছে, এবং মন্দির-মসজিদ বিতর্কের সমাধানে তার নিজস্ব সমাধান-সূত্রটা কী, সেটাও খুব একটা পরিষ্কার নয়।
বাবরি মসজিদ-রামমন্দির মামলা আজও ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন, আর গত মার্চ মাসে সেই শীর্ষ আদালতই বলেছিল ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত এই সমস্যাটি কোর্টের বাইরে মীমাংসা করতে পারলেই সবচেয়ে ভাল হয়।
এরপর গত সেপ্টেম্বর মাসে ভারতে মুসলিম ইমামদের একটি সংগঠন ও হিন্দুদের নির্মোহী আখড়ার প্রতিনিধিরা-সহ অনেকেই দেখা করতে যান আর্ট অব লিভিং ফাউন্ডেশনে’র কর্ণধার রবিশঙ্করের সঙ্গে – এবং এই বিতর্কে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাবে তিনি রাজি হয়ে যান।
ধর্মগুরু রবিশঙ্করের বক্তব্য, আমি বিশ্বাস করি এই বিরোধের সেরা সমাধান হতে পারে কোর্টের বাইরেই, কারণ সে ক্ষেত্রেই কেবল হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় কাছাকাছি আসতে পারে, তাদের ঔদার্য দেখাতে পারে। আর আমি বারবার বলছি আমার নিজস্ব কোনও এজেন্ডা নেই, আমি সবার কথা শুনব – দেখব তারপর কী হয়।
তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ বলেও পরিচিত – এবং তার এই উদ্যোগে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব আড়াল থেকে সমর্থন দিচ্ছে বলেও অনেকে মনে করছেন।
তবে বুধবার লক্ষৌতে রবিশঙ্কর যখন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের সঙ্গে বৈঠকে ব্যস্ত, তখন সেই শহরেই বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির নেতা জাফরইয়াব জিলানি পরিষ্কার জানিয়ে দেন তারা আলোচনায় যাবেন না।
মি. জিলানি বিবিসিকে বলেন, উনি যদি মনে করেন বাবরি মসজিদের ওপর থেকে মুসলিমদের দাবি উঠিয়ে নেওয়াটাই সমাধান, তাহলে সেটা সম্ভব নয়। কারণ শরিয়তই মুসলিমদের সেই অধিকার দেয় না। এগুলো আসলে সব মিডিয়াকে দেখানোর জন্য করা, আর সরকারও চায় এসব করে বিষয়টা নিয়ে চর্চা চলতে থাকুক।
তবে এই ধর্মগুরু এখনও স্পষ্ট করে বলেননি এই বিতর্কের সমাধানে তার নিজস্ব কোনও ফর্মুলা আছে কি না।
কংগ্রেসের প্রবীণ এমপি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির প্রধান প্রদীপ ভট্টাচার্যের মতে সেটা যতক্ষণ না পরিষ্কার হচ্ছে ততক্ষণ এই উদ্যোগ সফল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
মি. ভট্টাচার্য বলছিলেন, ফর্মুলাটা কী দেশের মানুষ সেটাই এখনও জানে না। যদি ধরে নিই ফর্মুলাটা মথুরার মতো কিছু একটা, যেখানে রাম জন্মভূমি ও মসজিদ পাশাপাশি থাকবে, তাহলে সেটা কিন্তু আজকের তারিখে বিজেপির পক্ষে কিছুতেই মানা সম্ভব নয়।
এটা মেনে নেওয়ার মানে তাদের চূড়ান্ত পরাজয় – আর সে কারণেই আমার ধারণা এই উদ্যোগটা স্রেফ লোক দেখানো!
তিনি সেই সঙ্গেই যোগ করছেন, ‘রবিশঙ্করের পেছনে সরকারের মদত থাকতে পারে – কিন্তু সম্ভবত তিনি নিজে থেকেই এই দু:সাধ্যমত কাজটার দায়িত্ব যেচে পড়ে নিয়েছেন, যাতে একটা বিশাল কৃতিত্বের সঙ্গে তার নামটা যুক্ত হতে পারে’
লক্ষ্য করার বিষয় হল, মামলার অন্যতম আবেদনকারী পক্ষ বিশ্ব হিন্দু পরিষদও কিন্তু রবিশঙ্করের উদ্যোগ নিয়ে খুব উৎসাহিত নয়।
পরিষদের নেতা শরদ শর্মার যুক্তি, কই মুসলিমরা তো কখনও আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে আসেন না? তারা তো কেউ বলেন না যে আসুন, ওই জমি আমরা হিন্দু ভাইদের দিয়ে দিই? হিন্দুরাই বারবার মধ্যস্থতার কথা পাড়বে, নিজেদের সম্পত্তির দখল ফিরে পেতে দেনদরবার করবে – এটা আমাদের একেবারেই পছন্দ নয়।
তবে মি. রবিশঙ্কর ঠিক কী লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছেন, তার ইঙ্গিত মিলেছে অযোধ্যায় তিনি যার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন সেই অমরনাথ মিশ্রর কথায়।
মি. মিশ্র বলছেন, অযোধ্যায় ২৬টা মসজিদ আছে – আরও একটা বানানো যেতেই পারে। আর হিন্দুরা মসজিদ ভেঙেছে, কাজেই আর একটা মসজিদ বানিয়ে দেওয়ার দায়ও তাদের। কিন্তু সেটা অন্য কোথাও হতে হবে, রামলালার মূর্তি যেখানে আছে সেখান থেকে কিছুতেই সরানো যাবে না।
ফলে বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানে রামমন্দির – আর অযোধ্যারই দূরে কোথাও মসজিদ, হিন্দুত্ববাদীদের বিকল্প ফর্মুলাটা আপাতত এরকমই।
কিন্তু প্রধান মুসলিম সংগঠনগুলোর এখনও তা মানার প্রশ্নই নেই – এবং রবিশঙ্করও সেখান থেকে দুপক্ষকে আদৌ কোনও আপসে রাজি করাতে পারেন কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।