দেশে যে পরিমাণে ভুট্টার আবাদ হয় তা ব্যবহৃত হয় হাস-মুরগী ও মাছের খাবার হিসেবে। মাত্র ৫ শতাংশ ব্যবহৃত হয় পপকর্ণ কিংবা রোসটেট হিসেবে। তবে এবার এই ভুট্টা থেকে তেল উৎপাদনের কথা ভাবছে বিজ্ঞানীরা। যাতে করে কৃষকরা যেমন লাভবান হবে তেমনিভাবে পুষ্টিকর তেল পাবে ভোক্তারা। ইতিমধ্যেই এই কার্যক্রম শুরুও হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
মঙ্গলবার দুপুরে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউটে ভুট্টা থেকে তেল তৈরীর জন্য গবেষণা ও স্বপ্নের কথা উল্লেখ করেন আর্ন্তজাতিক খ্যাত সম্পন্ন বিজ্ঞানী এমেরিটাস সাইন্টিস্ট ও বিএআরসি’র সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. কাজী এম বদরুজ্জোদা।
গম ও ভুট্টার উন্নয়নে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কর্মশালা ২০২০ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. এছরাইল হোসেন। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আবদুল আউয়াল, ড. আবু জামান সরকার, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. নুর আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, বর্তমানে দেশে মোট ৫ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে ভুট্টা আবাদ হচ্ছে। আর উৎপাদন হচ্ছে ৪৬ লাখ ৫০ হাজার টন। এই পরিমাণ ভুট্টা থেকে প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার টন তৈল উৎপাদন করা সম্ভব। সাধারণ জাত থেকে ৩ থেকে ৪ শতাংশ পরিমাণে তেল আহরণ করা যায়, আর উন্নত জাত থেকে ৫ থেকে ৬ শতাংশ। মূলত ভুট্টার মধ্যে এম্ব্রাইওয়ে রয়েছে যা জার্ম নামে পরিচিত। এই এম্ব্রাইও অংশ ভুট্টা দানার ১১.৫ শতাংশ। এখান থেকেই তেল আহরণ করা হয়। বাকী ভুট্টা মুরগী, মাছ কিংবা অন্য খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণে ভুট্টার উৎপাদন হচ্ছে তার মধ্যে ৮৫ শতাংশ হাস-মুরগী, ১০ শতাংশ মাছের খাবার ও বাকী ৫ শতাংশ পপকর্ন, রোসটেট কিংবা অন্য খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। উৎপাদিত ভুট্টা কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে কনফ্লেক্স, চিপস, গমের আটার সাথে মিশিয়ে খাবার তৈরী করার উপরও জোড় দেন বিজ্ঞানীরা।
অনুষ্ঠানে আরও বলা হয়, প্রতি হেক্টরে ৯ দশমিক ২ টন করে ভুট্টার ফল হয়। প্রতি বিঘায় ভুট্টা চাষে খরচ হয় ১০ হাজার ৯৭৩ টাকা আর উৎপাদিত ভুট্টা বিক্রয় হয় ১৭ হাজার ৮২৩ টাকায়। যাতে করে বিঘাপ্রতি লাভ হয় ৬ হাজার ৮৪৯ টাকা। এছাড়াও বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উদ্ভাবিত জনপ্রিয় জাত বারি হাইব্রিড-৯, বারি হাইব্রিড-১৬ থেকে হেক্টরপ্রতি গড় ফলন হয় ১০ থেকে ১২ টন।
অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. কাজী এম বদরুজ্জোদা বলেন, ভুট্টার মধ্যে এম্ব্রাইওতে প্রায় ৪ শতাংশ তেল থাকে। ভুট্টা থেকে তেল পাওয়া গেলে বিদেশ থেকে তেল আনতে হবে না। ভুট্টার তেল আহরণ করা হলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে নিজস্ব উৎপাদিত তেল ব্যবহার করতে পারবে বাংলাদেশের মানুষ। আর সেই কারণেই এটা নিয়ে এখন কাজ করার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, আমি একসময় ভুট্টার আবাদ নিয়ে এসেছিলাম বাংলাদেশে। তখন নানা প্রতিকূল অবস্থা পার করে দেশে ভুট্টার চাষাবাদ শুরু করি ও গবেষণা শুরু করেছি। এখন ভুট্টা দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল এবং দিন দিন এর চাষাবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ভুট্টা এখন সম্ভাবনা দেখাচ্ছে তা থেকে তেল আহরণের। গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীদের এ নিয়ে আগ্রহ সহকারে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. এছরাইল হোসেন বলেন, ইতিমধ্যেই ভুট্টা থেকে তেল তৈরী করার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে গবেষণাও চলছে। মূলত ওয়েট মিলিং পদ্ধতিতে ভুট্টার জার্ম বাই প্রডাক্ট হিসেবে আলাদা করা হয়। এ পদ্ধতিতে ইষ্টিম ও একয়াস ইথানল ব্যবহার করা হয়। সাধারনত ইষ্টিম প্রেসার, সেটেল্ট সময়, পারটিকেল সাইজ এবং ইথানল কনসেনট্রেশন বিশেষ ভুমিকা রাখে। ইষ্টিম প্রেসার (১.৩এমপিএ), সেটেল্ট সময় (৩০ সেকেন্ড), পারটিকেল সাইজ (৩০-৩৫ মাইক্রোমিটার) এবং ইথানল (৩০%) কনসেনট্রেশন যা ২ ঘন্টা ৬০ ডিগ্রী সেলসিয়া, পিএইচ ৯.০ থাকে। এভাবে প্রাথমিকভাবে ক্রুড ওয়েল এবং পরবর্তী ধাপে ফিল্টারিং করে রিফাইন ওয়েল পাওয়া যায়।
ভুট্টার তেল উৎপাদনের জন্য চায়নার দুটি কোম্পানী ও ভারতের একটি কোম্পানীর সাথে আলোচনাও হচ্ছে। খুব শীঘ্রই দেশের উৎপাদিত ভুট্টা থেকে তেল তৈরীর কার্যক্রম শুরু হবে বলে আশাবাদ ব্যাক্ত করেন তিনি।