স্টাফ রিপোর্টারঃ বাংলাদেশে গেল দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘টার্গেট কিলিং’ চলে এলেও জঙ্গিদের শক্ত অবস্থান সম্পর্কে দেশের মানুষ ধারণা পেয়েছেন মূলত ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় হামলার পর। এরপর কল্যাণপুরের ‘জাহাজ বিল্ডিংয়ে’ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানও দেখিয়েছে কত শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে জঙ্গিরা।
জঙ্গিবাদের সমস্যাকে আইন-শৃঙ্খলাজনিত কোনো সমস্যা বলে মনে করেন না বিশেষজ্ঞরা এবং তা প্রতিরোধে আদর্শিক সংগ্রামকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সারা দেশে জঙ্গিবিরোধী মিছিল-সমাবেশের পাশাপাশি আদর্শিক সংগ্রাম গড়ে তোলা প্রয়োজন। উগ্রবাদীদের মোকাবিলায় শুধু মিছিল-সমাবেশ করে থেমে থাকলেই এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। প্রচলিত রাজনৈতিক কর্মসূচি ছাড়াও বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
তারা বলছেন, মিছিল-সমাবেশ প্রাথমিক কর্মসূচি। তবে দীর্ঘস্থায়ী কর্মসূচির অংশ হিসেবে আদর্শিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রাম প্রয়োজন। সমাজের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং আদর্শিকভাবে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
গত ১৪ জুলাই যুক্তরাজ্যভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইএস-প্রধান বাগদাদীকে হত্যা করলেও বিশ্বব্যাপী চলমান সন্ত্রাসবাদের সমাধান আসবে না। বরং ইসলামিক স্টেট যে আদর্শের কথা বলছে সেটাকে মোকাবিলা করতে হবে আদর্শিকভাবেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটা হচ্ছে আশু করণীয়, আরেকটা দীর্ঘস্থায়ী করণীয়। দীর্ঘস্থায়ী করণীয়টা হচ্ছে সাংস্কৃতিক। আমাদের এখানে সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক চর্চা নেই। এই জায়গাটা খুব সংকীর্ণ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নেই, লাইব্রেরি নেই, আগের মতো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও নেই, খেলার মাঠ নেই। আমাদের তরুণদের যত্ন নিতে হবে। তারা অন্ধকারের দিকে চলে যাচ্ছে, কারণ সামনে আলো নেই।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ দরকার হবে, পাড়া-মহল্লায় মাঠ দরকার হবে, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম দরকার হবে। এটা না করলে আমরা এগোতে পারবো না। আমাদের বিপদ বাড়বে এবং যে দিকে যাচ্ছি সে দিকেই যাবো।’
বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে এই শিক্ষাবিদ বলেন, আশু কর্তব্য হলো, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যেমন সর্বদলীয় কমিটির অধীনে হয়েছে, ওইরকম সর্বদলীয় কমিটি করতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে করতে হবে এবং স্থানীয়ভাবে করতে হবে, যারা জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে কাজ করবে। এটা আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা নয়, এটা বড় সাংস্কৃতিক সমস্যা।’
তিনি বলেন, ‘এটা একটা মতাদর্শগত সংগ্রাম। হত্যা করে এ থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। যত হত্যা করা হবে তত ওরা শহীদ হতে উদ্বুদ্ধ হবে। নির্যাতন, নিপীড়ন কোনো পথ নয়। উত্তরণের পথ হলো মানুষকে বোঝানো। একাত্তর সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে সমাজ পরিবর্তনের দুটো রাজনৈতিক ধারা ছিল। একটা জাতীয়তাবাদী আরেকটা সমাজতান্ত্রিক। এই দুটো ধারা সমান্তরালে গেছে আবার একসাথে মিশেছে।’
এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় আছে, সমাজতান্ত্রিকরা একেবারে দূর্বল হয়ে গেছে। জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ তারা পুঁজিবাদে দীক্ষিত। জঙ্গিবাদের সমস্যা পুঁজিবাদের তৈরি। আমেরিকা জঙ্গি তৈরি করেছে। এদের লক্ষ্য ছিল সমাজতন্ত্রিদের ধ্বংস করা।’
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করলে কাদের দিয়ে করানো হবে এইগুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর করতে হবে। কেন এইগুলো হচ্ছে- এর বিপরীতে কী করতে হবে। এটা তো একটা আদর্শিক সংগ্রাম। সেই আদর্শিক সংগ্রাম তো আর মিটিং-মিছিল করে হবে না। একটা ‘কাউন্টার আইডিওলজি’ (বিপরীত আদর্শ) তৈরি করতে হবে। শুধু মিছিল-মিটিং দিয়ে এগুলো সম্ভব হলে দুনিয়াতে এগুলো থাকতোই না।’
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার নেতা সাইফুল হক বলেন, ‘নিরাপত্তা সংক্রান্ত ধারণাগুলো তো আগের মতো নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা সেনাবাহিনীকে নামিয়ে এই ধরনের সংকট পৃথিবীর কোথাও মোকাবিলা করা যায়নি, এখানেও যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘একটা আদর্শিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক দিক আছে। সমাজের মানুষ রাজনৈতিক, সামাজিক এবং আদর্শিকভাবে যত বেশি সচেতন হয়ে উঠবেন তত বেশি আমরা বিচ্ছিন্ন শক্তিগুলোকে আরো গণবিচ্ছিন্ন করতে পারবো এবং সমাধানের দিকে যেতে পারবো।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মিটিং-মিছিল অব্যাহত রাখতে হবে প্রতিবাদের কৌশল হিসেবে। রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে অপকর্মকারীদের প্রতিহত করেনি বরং ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে। এই লড়াই কঠিন লড়াই। উগ্রচিন্তার একটা মতাদর্শ যে তৈরি হয়েছিল, সেটা তো আমরা গত এক দশক ধরে জানি। আমরা চুপ করে বসে থেকে অন্য কাজ করেছি।’
তিনি বলেন, ‘সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়নি, শিক্ষা কারিক্যুলামে পরিবর্তন আসেনি, ইংলিশ মিডিয়াম-মাদরাসায় মাতৃভাষার চর্চা হয়নি, সৃজনশীল শিক্ষা আসেনি, ছেলে-মেয়েদের আমরা খণ্ডিত নাগরিক-মানুষ হিসেবে তৈরি করেছি।’