প্রতিবেদক : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল চেয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে একমত নন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে সংবিধানে যেসব অনুচ্ছেদ রয়েছে সরকার তা সম্পূর্ণভাবে মেনে চলছে।
দেশের বিচারাঙ্গনের প্রধান ব্যক্তি বিচারপতি এস কে সিনহা শনিবার এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করে তা বাতিলের সুপারিশ করেন।
ওই বক্তব্যের সময় আইনমন্ত্রীর কথার প্রসঙ্গও তুলেছিলেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, “আমি কোনো এক অনুষ্ঠানে বলেছিলাম এদেশে দ্বৈত শাসন চলছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আইনমন্ত্রী বললেন যে দ্বৈত শাসন চলে না।”
বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও বদলি-পদায়ন থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে স্বাধীনভাবে পদক্ষেপ নিতে না পারার বিষয়টি তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতি।
সেই দ্বৈত শাসনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “আমাদের ১১৬ এবং ১১৬ (এ) সংবিধানের প্রিন্সিপালসের সাথে কনফ্লিক্ট করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে এই দুই বিধান সংবিধানের পরিপন্থি, যা আমাদের পবিত্র বই থেকে অতি তাড়াতাড়ি সরিয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। এটা থাকায় আমাদের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।”
সংবিধানের ওই দুটি অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা এবং বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের বিচারকাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীনতার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
১১৬ অনুচ্ছেদে রয়েছে – বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল- নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরীসহ) ও শৃংখলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রীম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।
১১৬ (৪) অনুচ্ছেদে রয়েছে- এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিষ্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।
রোববার বাংলা একাডেমিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে, যিনি নিজেও সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী।
আনিসুল হক বলেন, “(প্রধান বিচারপতির বক্তব্য) খবরের কাগজে পড়েছি। আমি মনে করছি যে, খবরের কাগজে হয়ত উনার পূর্ণাঙ্গ বক্তব্যটা আসেনি।
“সেটা বোঝার জন্য আমি অলরেডি সুপ্রিম কোর্টকে অনুরোধ করেছি, উনি (প্রধান বিচারপতি) যদি লিখিত বক্তব্য দিয়ে থাকেন, তাহলে সেই কপিটা যেন আমাকে অনুগ্রহ করে দেওয়া হয়। সেজন্য যতক্ষণ পর্যন্ত কপিটা না পাই ততক্ষণ পর্যন্ত আমি কোনো বক্তব্য দিয়ে কোনো ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হোক, সেটা আমি চাই না।”
“সেজন্য আমি বক্তব্য দেব না, কিন্তু আমি একটা কথা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলব সেটা হচ্ছে- এখন যেই অনুচ্ছেদগুলো (সংবিধানে) আছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ব্যাপারে, অনুচ্ছেদ ১১৬ (ক)-তে যেটা আছে, সেটা কিন্তু সরকার বা নির্বাহী বিভাগ সম্পূর্ণভাবে মেনে চলে,” বলেন আইনমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “বিচারিক কাজে বিচারক এবং বিচারপতিবৃন্দকে কোনোভাবেই নির্বাহী বিভাগ কোনো হস্তক্ষেপ করে না। এটা আমরা করি না। এটা বাংলাদেশের কালচারে আগে যা ছিল, তার আমূল পরিবর্তন কিন্তু হয়েছে এবং সেজন্যই আমি মনে করি ১১৬ (ক) আমরা সম্পূর্ণভাবে নির্বাহী বিভাগ বলেন, অন্যান্য বিভাগ বলেন, আমরা সম্পূর্ণ মেনে চলছি, সম্মান করে যাচ্ছি এবং সম্মান করে যাব।”
এদিন বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আরেকটি অনুষ্ঠানে আনিসুল হক বলেন, “এই সরকার বিচার বিভাগ স্বাধীন করার জন্য সব থেকে বেশি পরিশ্রম করেছে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দেওয়ার ব্যাপারে কোনো রকম কার্পণ্য করেনি।
“সংবিধানের ১১৬ (ক) অনুচ্ছেদ যেটা বলা আছে, বিচারিক কাজে বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকবে এই সরকার অক্ষরে অক্ষরে সেটা পালন করে। আমরা কোনো বিচারিক কাজে কখনই হস্তক্ষেপ করি না।”
একইসঙ্গে তিনি বলেন, “কিন্তু হস্তক্ষেপ না করার পরেও এটুকু আমাদেরকে বলতেই হয় যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী কোনো কাজ, কোনো রায় আমরা কিন্তু গ্রহণ করব না।
“কারণ এই দেশটা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি। আমরা বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার স্বাধীনতা পেয়েছি, সেই স্বাধীনতা আমরা কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না।”
বিচার বিভাগকে ডিজিটাইজড করায় মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন বিচারপতি এস কে সিনহা।
“জুডিশিয়ারিকে ডিজিটালাইজড করার জন্য একনেকে পাস হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় পূরণ হবে না। দেশ ডিজিটালাইজেশন করার জন্য যদি প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় পূরণ না হয় তাহলে কোনটা হবে আমি বুঝলাম না।”
চাঞ্চল্যকর একটি মামলায় আসামিদের খালাস পাওয়ার রায় নিয়ে সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায় প্রসিকিউশন ও তদন্ত কর্মকর্তাদের সমালোচনা করেন প্রধান বিচারপতি।
“অতি দুঃখের সাথে আমরা লক্ষ্য করেছি, প্রত্যেকটি মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা এবং প্রসিকিউশনে এত এত ত্রুটি। এত ত্রুটি যে, আমরা বিচারে যখন আসি, তখন চোখ বন্ধ করে রায় লিখতে পারি না।”
বিনা বিচারে যারা কারাগারে রয়েছে, তার জন্য কে দায়ী হবে- সেই প্রশ্নও আইনমন্ত্রীকে রাখেন সাংবাদিকরা।
আনিসুল হক বলেন, “কোনো একজনকে এ ব্যাপারে দায়ী করা যায় না। সামগ্রিকভাবে অনেক সময় পদক্ষেপের জন্য, আইন না জানার জন্য অনেক সময় পদক্ষেপ নেওয়া থেকে অনেকে বিরত থাকেন, আমি সেটাকে দায়ী বলব না।
“আবার অনেক সময় ভুলবশত কারাগারে থাকতে হয়। আমার কথা হচ্ছে, আদালত যে কাজটা করেছেন … বলেছেন আইওকে (জরিমানা) দিতে হবে, এখানে যদি আইওকে আদালত সব বিবেচনার পরে দোষী সাব্যস্ত করে থাকেন, আমার মনে হয় সেটা মেনে নেওয়া উচিৎ। এই মেসেজটা যদি পরিষ্কার হয় তাহলে এইসব বিনা বিচারে আটক থাকার মানুষ অনেক কমে যাবে।”
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া প্রণয়নের কাজ করছে বলেও জানান আইনমন্ত্রী।