প্রতিবেদক : রাষ্ট্রপতি ‘প্রয়োজন নেই’ বলে ‘সিদ্ধান্ত’ দিলেও সর্বোচ্চ আদালত অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট প্রকাশ করতে সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক সোমবার আদালতের তলবে হাজির হওয়ার পর প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে আট বিচারকের আপিল বেঞ্চ বলেছে, বিধিমালা নিয়ে “রাষ্ট্রপতিকে ভুল বোঝানো হয়েছে।”
বার বার সময় দেওয়ার পরও সরকার মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে ওই বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ না করায় গত ৮ ডিসেম্বর দুই সচিবকে তলব করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সোমবার সকাল ৯টায় তাদের আদালতে হাজির করতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
দুই সচিবের হাজির করার ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মোশতাক আহাম্মদ স্বাক্ষরিত একটি নোটিস প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে রাষ্ট্রপতি ‘সিদ্ধান্ত’ দিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাই কোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার এবং অ্যাটর্নি জেনারেলসহ সংশ্লিষ্টদের এ নোটিসের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে বলে নোটিসে জানানো হয়।
আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী দুই সচিব সোমবার সকালে আপিল বিভাগে হাজির হন। কার্যক্রম শুরুর পর অ্যাটর্নি জেনারেল আইন মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার কথা আদালতকে জানান এবং তা পরে শোনান।
নোটিসে যা আছে
“বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জন্য পৃথক আচরণ বিধিমালা, শৃঙ্খলা বিধিমালা এবং বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (সার্ভিস গঠন, সার্ভিস পদে নিয়োগ ও বরখাস্তকরণ, সাময়িক বরখাস্তকরণ ও অপসারণ) বিধিমালা-২০০৭ সংশোধনকল্পে সুপ্রিম কোর্টের প্রস্তাবিত খসড়া বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা নেই মর্মে রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।”
এরপর প্রধান বিচারপতি বলেন, “পার্লামেন্টারি সিস্টেমে রাষ্ট্রপতি নামমাত্র। যা আপনারা পাঠিয়েছেন তাই করবেন।”
তিনি বলেন, মাসদার হোসেন মামলার ৮০ শতাংশ রায় সরকার ‘মেনেই নিয়েছে’। অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধির এই খসড়া সরকারই দিয়েছে।
“এটা ভুল বোঝাবুঝির বিষয় নয়। অনেক সময় পেয়েছেন, আমরা অনেক সময় দিয়েছি।”
শুনানির এক পর্যায়ে আইনসচিব বলেন, আদালত যেভাবে আদেশ দেবে, সেভাবেই করা হবে।
শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি গেজেট করে আনতে বলে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বিষয়টি মুলতবি করেন।
মামলা বৃত্তান্ত
মাসদার হোসেন মামলার চূড়ান্ত শুনানি করে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে ঐতিহাসিক এক রায় দেয়।
ওই রায়ে আপিল বিভাগ বিসিএস (বিচার) ক্যাডারকে সংবিধান পরিপন্থি ও বাতিল ঘোষণা করে। একইসঙ্গে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস ঘোষণা করা হয়। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। আপিল বিভাগের নির্দেশনার পর গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়।
সরকারের খসড়াটি ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার অনুরূপ হওয়ায় তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি বলে গত ২৮ আগাস্ট শুনানিতে জানায় আপিল বিভাগ।
এরপর ওই খসড়া সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্ট আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেইসঙ্গে ৬ নভেম্বরের মধ্যে তা চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন আকারে আদালতে উপস্থাপন করতে বলা হয় আইন মন্ত্রণালয়কে।
গত ৬ নভেম্বর সে অনুসারে মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি জানাতে পারেননি। পরে আপিল বিভাগ বিধিমালা চূড়ান্তের বিষয়ে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তা লিখিতভাবে জানাতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দিয়ে ৭ নভেম্বর আদেশের দিন ধার্য করে।
ওই দিন অ্যাটর্নি জেনারেল সময়ের আবেদন জমা দেন, যাতে বিধিমালাটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর কথা উল্লেখ করেন তিনি। তখন সর্বোচ্চ আদালত ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দেন। ২৪ নভেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেল গেজেট প্রকাশে আরও এক সপ্তাহ সময় চাইলে আপিল বিভাগ তা মঞ্জুর করে। পরে ১ ডিসেম্বর আইনমন্ত্রী ফিলিপিন্সে রয়েছেন বলে ফের এক সপ্তাহ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ।
এরপর ৮ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি শুনানিতে উপস্থিত অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, “আপনাকে মৌখিকভাবে বলছি, সোমবার সকাল ৯টায় দুই সচিবকে নিয়ে হাজির হবেন। এটা একটা মেসেজ। পারলে ওই দুইজনকে আইনের খসড়া নিয়ে হাজির হতে বলবেন।”
বাংলাদেশের সংবিধান
‘দ্বৈত শাসন’
বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও বদলি-পদায়ন থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে স্বাধীনভাবে পদক্ষেপ নিতে না পারার কথা বলে আসছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।
এই বিষয়টিকে ‘দ্বৈত শাসন’ আখ্যায়িত করে শনিবারও এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমাদের ১১৬ এবং ১১৬ (এ) সংবিধানের প্রিন্সিপালসের সাথে কনফ্লিক্ট করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে এই দুই বিধান সংবিধানের পরিপন্থি, যা আমাদের পবিত্র বই থেকে অতি তাড়াতাড়ি সরিয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। এটা থাকায় আমাদের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।”
সংবিধানের ওই দুটি অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা এবং বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের বিচারকাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীনতার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
১১৬ অনুচ্ছেদ: বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল- নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরীসহ) ও শৃংখলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।
১১৬ (ক) অনুচ্ছেদ: এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিষ্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।
প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক রোববার সাংবাদিকদের বলেন, “এখন যেই অনুচ্ছেদগুলো (সংবিধানে) আছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ব্যাপারে, অনুচ্ছেদ ১১৬ (ক)-তে যেটা আছে, সেটা কিন্তু সরকার বা নির্বাহী বিভাগ সম্পূর্ণভাবে মেনে চলে।
“বিচারিক কাজে বিচারক এবং বিচারপতিবৃন্দকে কোনোভাবেই নির্বাহী বিভাগ কোনো হস্তক্ষেপ করে না। এটা আমরা করি না … আমি মনে করি ১১৬ (ক) আমরা সম্পূর্ণভাবে নির্বাহী বিভাগ বলেন, অন্যান্য বিভাগ বলেন, আমরা সম্পূর্ণ মেনে চলছি, সম্মান করে যাচ্ছি এবং সম্মান করে যাব।”