প্রতিবেদক : সাঁওতালদের আগুন দেওয়ার সঙ্গে পুলিশ জড়িত কিনা এবং কারা ওই ঘটনায় দায়ী- তা খতিয়ে দেখে বিচারিক হাকিমকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে হাই কোর্ট।
সাঁওতালদের ঘরে পুলিশের আগুন দেওয়ার একটি ভিডিও নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল আলোচনা শুরুর পর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি সম্পূরক আবেদনে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার এই আদেশ দেয়। পাশাপাশি সাঁওতালদের উচ্ছেদের সময় ভাংচুর, লুটপাট ও হতাহতের ঘটনায় দায়ের করা একটি এজাহার ও একটি জিডি মামলা হিসেবে নিয়ে সমান গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে বলেছে আদালত।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অন্যূন পুলিশ সুপার মর্যাদার কোনো কর্মকর্তার মাধ্যমে এই তদন্ত তদারকের ব্যবস্থা করতেও রংপুর রেঞ্জের ডিআইজিকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।
১৯৬২ সালে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল।
ওই জমি ইজারা দিয়ে ধান ও তামাক চাষ করে অধিগ্রহণের চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলে তার দখল ফিরে পেতে আন্দোলনে নামে সাঁওতালরা। পরে সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে বিরোধপূর্ণ চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে কয়েকশ’ ঘর তুলে বসবাস শুরু করে তারা।
গত ৬ নভেম্বর চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। ওই ঘটনায় তিন সাঁওতাল নিহত ও অনেকে আহত হয়।
সংর্ঘষের পর গোবিন্দগঞ্জ থানার এসআই কল্যাণ চক্রবর্তী ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে সাড়ে ৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় চার সাঁওতালকে গ্রেপ্তার করার পর তারা জামিনে মুক্তি পান।
অন্যদিকে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুট ও উচ্ছেদের ঘটনায় মুয়ালীপাড়া গ্রামের সমেস মরমুর ছেলে স্বপন মুরমু গত ১৬ নভেম্বর অজ্ঞাতনামা ৬০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন; তার মামলায় ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ঘটনার দশদিন পর গত ২৬ নভেম্বর সাঁওতালদের পক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত থোমাস হেমব্রম বাদী হয়ে ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে ৫০০-৬০০ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ দাখিল করেন। আগে একটি মামলা থাকায় পুলিশ তার অভিযোগ এজাহার হিসেবে না নিয়ে জিডি হিসেবে নথিভুক্ত করে।
হাই কোর্ট বুধবারের আদেশে বলেছে, দুটি অভিযোগই এজাহার হিসেবে নিয়ে সমান গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে হবে।
সাঁওতালদের জানমাল রক্ষা, নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণ, স্বাধীনভাবে চলা-ফেরার সুযোগ দিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে গত ১৬ নভেম্বর আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), ব্রতী সমাজ কল্যাণ সংস্থা হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করে।
পরদিন এ বিষয়ে শুনানি করে সাঁওতালদের ধান কাটার সুযোগ দিতে অথবা ধান কেটে তাদের বুঝিয়ে দিতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেয় আদালত। সাঁওতালদের সম্পত্তি ও জানমাল রক্ষায় ‘প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না’- তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করা হয়।
আদালত উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতালদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং বাইরে চলাচলের ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা দিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়। তাদের নিরাপত্তার জন্য কী কী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং উচ্ছেদের সময় ভাংচুর-লুটপাটের ঘটনায় কয়টি মামলা হয়েছে সে বিষয়েও গাইবান্ধার পুলিশ সুপার ও গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসিকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলে।
এদিকে উচ্ছেদের সময় গুলিতে আহত সাঁওতাল দ্বিজেন টুডোর স্ত্রী অলিভিয়া হেমব্রম এবং গণেশ মুরমুর স্ত্রী রুমিলা কিসকুর পক্ষে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ২১ নভেম্বর হাই কোর্টে আরেকটি রিট আবেদন করেন। সেখানে সাঁওতালদের ওপর ‘হামলার ঘটনা’ তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়।
পরদিন এ বিষয়ে শুনানি করে রুল দেয় আদালত। সাঁওতালদের উচ্ছেদের নামে তাদের মারধর, লুটপাট, গুলি ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং উচ্ছেদের নামে ওইসব কর্মকাণ্ড কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না রুলে তা জানতে চাওয়া হয়।
দুটি রুলের শুনানি চলাকালে গত ৬ ডিসেম্বর গাইবান্ধার জেলা প্রশাসককে তলব করে হাই কোর্ট। উচ্ছেদের সময় গুলির ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনের আদেশে সাঁওতালদের ‘বাঙ্গালী দুষ্কৃতিকারী’ বলার ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয় তার কাছে।
সাঁওতালদের পক্ষে করা প্রথম মামলার বাদী স্বপন মরমুকেও ১২ ডিসেম্বর আদালতে হাজির করতে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার ও গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট।
জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সামাদ ১২ ডিসেম্বর হাই কোর্টে উপস্থিত হয়ে বলেন, গাইবান্ধা পুলিশের বিশেষ শাখার সুপার যে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন, তাতে ‘বাঙ্গালী দুষ্কৃতিকারী’ শব্দটি ছিল, যা তদন্ত কমিটি গঠনের চিঠিতেও ‘অসাবধানতাবশত’ চলে আসে।
তিনি আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলে বিচারক তাকে রেহাই দেন এবং গাইবান্ধা পুলিশের বিশেষ শাখার সুপারকে ২ জুনয়ারি হাই কোর্টে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেন।
ফেইসবুকে আসা ভিডিওর স্ক্রিনশট
এদিকে ঘটনার প্রায় এক মাস পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসা একটি ভিডিওর ভিত্তিতে সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।
ওই ভিডিওতে দেখা যায়, সাঁওতাল পল্লীর ভেতরে পুলিশ সদস্যরা গুলি ছুড়ছেন। কয়েকজন পুলিশ সদস্য একটি ঘরে লাথি মারছেন এবং পরে এক পুলিশ সদস্য ওই ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেন। পুলিশের সঙ্গে সাধারণ পোশাকে থাকা আরেকজন আগুন অন্য ঘরে ছড়িয়ে দিতেও সহায়তা করেন।
ভিডিওর একটি অংশে আরও কয়েকটি ঘরে আগুন দিতে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের। তাদের মাথায় ছিল হেলমেট, একজনের পোশাকের পিঠে ডিবি, আরেকজনের পুলিশ লেখা ছিল।
পুলিশ আগুন দেওয়ার কথা অস্বীকার করলেও নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এরপর আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বুধবার একটি সম্পূরক আবেদন করে, যেখানে পুলিশের আগুন দেওয়ার ঘটনা তদন্তের নির্দেশনা চাওয়া হয়।
আসকের পক্ষে শুনানি করেন আবু ওবায়দুর রহমান। ক্ষতিগ্রস্ত দুই সাঁওতালের পক্ষে ছিলেন জ্যেতির্ময় বড়ুয়া। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।