প্রতিবেদক : চার বছর আগে ঢাকার পল্লবীতে ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্র অমিত সাহাকে হত্যার দায়ে তার দুই বন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। বৃহস্পতিবার ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন বৃহস্পতিবার আসামিদের উপস্থিতিতে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
তিন আসামির মধ্যে আশফাক আহমেদ শিহাব ও আল আমিন ইসলাম পিন্টুর সর্বোচ্চ সাজার আদেশ হয়েছে। আর রুহুল আমিন রুবেলের হয়েছে যাবজ্জীন কারাদণ্ড। ২০১২ সালের ২১ নভেম্বর পল্লবীর এক বাসায় খুন হন ২০ বছর বয়সী অমিত। ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসনের ছাত্র ছিলেন তিনি।
হত্যাকারীরা তার লাশ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে বাসা থেকে ল্যাপটপ, ট্যাব, সোনার গয়নাসহ প্রায় নয় লাখ টাকার মালামাল নিয়ে যায় বলে মামলার নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
অমিতের বাবা ও মামলার বাদী ব্যবসায়ী শ্যামল চন্দ্র সাহা জানান, ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর স্ত্রী রিক্তা ও ছেলেকে নিয়ে তীর্থ দর্শনে ভারতে গিয়েছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ সেমিস্টারের পরীক্ষা দিতে তাদের ভারতে রেখেই ১০ নভেম্বর দেশে ফেরেন অমিত।
দেশে ফেরার পর পল্লবীর বাসায় মামা কৃষাণ সাহার সঙ্গে থাকছিলেন অমিত। ঘটনার দিন বিকালে কৃষাণ সাহা কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরে অমিতের শোবার ঘরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে টাই দিয়ে বাঁধা অবস্থায় অমিতের লাশ ঝুলতে দেখেন।
খবর পেয়ে দেশে ফিরে ছেলের বন্ধু শিহাব, পিন্টু ও রুবেলের নাম উল্লেখ করে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন শ্যামল সাহা।
আসামিরা প্রথমে ওই ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করলেও পরে আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। তাদের কাছ থেকে লুট করা কিছু মালামালও উদ্ধার করে পুলিশ।
তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ২৯ এপ্রিল তিন আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। বাদীপক্ষে ২১ জনের সাক্ষ্য শুনে আদালত বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করে।
সাজা
রায়ে বলা হয়, আসামিরা অমিতকে চেতনানাশক মেশানো জুস খাইয়ে ওই বাসায় লুটপাট চালায়। কিন্তু অমিত দেখে ফেলেছেন বলে সন্দেহ হওয়ায় শিহাব ও পিন্টু তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন।
আদালত বলেছে, রুবেলের সম্পৃক্ততা ছিল মালপত্র লুটের পরিকল্পনার সঙ্গে। হত্যাকাণ্ডে তার সরাসরি অংশগ্রহণ প্রমাণিত হয়নি।
# হত্যার ঘটনায় শিহাব ও পিন্টুর মৃত্যুদণ্ড। আর রুবেলের যাবজ্জীন সাজার পাশাপাশি এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড।
# লুটপাটের ঘটনায় তিন আসামির সবাইকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড।
# লুণ্ঠিত মালামাল লুকিয়ে রাখার ঘটনায় আসামিদের সবাইকে তিন বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড।
# সব সাজা একযোগে কার্যকর হবে। সেক্ষেত্রে শিহাব ও পিন্টুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কেবল মৃত্যুদণ্ড।
আদালতের পর্যবেক্ষণ
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, “তিন অক্ষরের ‘বন্ধু’ শব্দটির অর্থ হল- সে শত্রু নয় এবং তার ওপর বিশ্বাস রাখা যায়। বন্ধুত্ব হচ্ছে মমত্ব, আনুগত্য, ভালবাসা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থা ও গভীর বিশ্বাসের মিশ্রণ। বন্ধুত্বের মধ্যে লোভ লালসা থাকবে কেন? কী অপরাধ ছিল অমিত সাহা এবং তার পরিবারের? বন্ধু নির্বাচনই কী তার অপরাধ ছিল? নাকি অমিত সাহার পরিবারের ভুল ছিল বন্ধুনামীয় শত্রুদের সাথে অমিত সাহাকে মিশতে দেওয়া?
“আসামিরা বন্ধুত্বের পরিচয়ে যে নৃশংস ঘটনার অবতারণা করেছে তার পুনরাবৃত্তি না হোক- এ আদালত তা মনে করে। সে কারণে কৃতকর্মের জন্য আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যুক্তিসঙ্গত। এতে ন্যায়বিচার হবে বলে আদালত মনে করে।”
প্রতিক্রিয়া
আসামি রুবেলের মা আদালতে রায় শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লেও সাজা পাওয়া তিন আসামি ছিলেন নির্বিকার।
রুবেলের আইনজীবী সাফায়েত হোসেন সজিব বলেন, “রায়ে আমার মক্কেল ন্যায়বিচার পাননি, আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব।”
বাদী শ্যামল সাহা এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “শিহাবের পরিবার আর্থিকভাবে আমাদের চাইতে অস্বচ্ছল। আমি নানা সময়ে তাদের সাহয্য করার চেষ্টা করতাম… কিন্তু তারা যে এই কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে তা বুঝতে পারিনি।”
এই রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানান অমিতের বাবা।