প্রতিবেদক : নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সামাজিক ব্যবসা হচ্ছে পরের মঙ্গলের জন্য ব্যবসা। দেশের, সমাজের ও মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্যই এ ব্যবসা করা। এ ব্যবসা কাউকে ব্যক্তিগত কোনো মুনাফা দেয় না। মুনাফাটা ব্যবসার মধ্যে রেখে দেওয়া হয়। সে টাকা দিয়ে সে ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারিত করা হবে। ইংরেজিতে যেটিকে বলা হয়, নন–ডিভিডেন্ড কোম্পানি ফর সলভিং আ সোশ্যাল প্রবলেম।
শনিবার সকালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ১৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘সামাজিক ব্যবসা প্রেক্ষাপট: বিশ্ব ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক বক্তব্যে ড. ইউনূস এসব কথা বলেন।
সামাজিক ব্যবসার উপকারিতা এবং এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সামাজিক ব্যবসার ধারণা নিয়ে ঢাকায় একটি নার্সিং কলেজ ও অটোমেকানিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ার সময় শিক্ষার্থীদের কোনো অর্থ খরচ করতে হয়নি। প্রতিষ্ঠানই ব্যয় নির্বাহ করেছে। তবে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর সে অর্থ মাসিক কিস্তি আকারে শোধ করবেন।
আরেকটি নার্সিং কলেজের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কাছ থেকে অন্যান্য আবাসিক এলাকায় একটি জায়গা নেওয়া হয়েছে বলে জানান ড. ইউনূস। সেখানে নার্সিং কলেজ, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
এসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে সভায় আক্ষেপ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘এ সমস্ত জায়গায় আমাদের মুশকিল হয়ে যায়, বলাও মুশকিল এসব কথা। সরকারের অনুমোদন পেতে আমাদের বড় কষ্ট হয়। ওখানে কেউ গ্রামীণ নাম দেখলে আর ওটাতে হাত দিতে চায় না, যেকোনো বিপদে পড়ি আবার! অনুমতির জন্য আমরা আটকে থাকি। কাউকে অভিযোগও করতে পারি না। কত দিন লাগে এ অনুমতি দিতে? সেটি এখন ভবিষ্যতের ব্যাপার। যদি অনুমোদন দেয়, তাহলে আমরা চট করে করে ফেলতে পারব। আমাদের করার কিছু নেই। কিন্তু আমাদের সমস্ত প্রস্তুতি কমপ্লিট।’
সভায় গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন জোবরা গ্রামের কৃষকের সেচের সংকট মেটাতে ‘তেভাগা আন্দোলন’ শুরু করার কথাও জানান তিনি।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, মহাজনদের উৎপাত থেকে রক্ষা করার জন্য নিজের পকেট থেকে কৃষকদের টাকা দেওয়া শুরু করেন। ১৯৭৬ সালে এটি শুরু হলো। ১৯৮৩ সালে এটি ব্যাংকে রূপান্তরিত হলো। আইডিয়া হলো, এটার মালিক হবেন গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যরা। এটি ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চলবে। লাভের টাকা ঋণগ্রহীতাদের কাছেই ফিরে যাবে। বাইরের কেউ পাবে না।
গ্রামীণ ব্যাংক–সংক্রান্ত আইন করতে গিয়ে শুরু হওয়া সমস্যার চক্কর থেকে এখনো বের হতে পারেননি বলে মন্তব্য করেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আইন করতে যখন গেলাম, তখন মন্ত্রণালয় থেকে বলা হলো যে এভাবে তো পারবেন না। সরকারকে কিছু শেয়ার দিতে হবে। এই যে বিপদে পড়েছি, এ বিপদ থেকে এখনো মুক্ত হইনি। এ চক্কর এখনো চলছে।’
ওই সময়ের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে ইউনূস বলেন, ‘আমি বললাম যে ঠিক আছে ৫ শতাংশ দিই, ১০ শতাংশ দিই। তারা যখন আইন বানাল, সে আইনে তারা করে দিল ৭৫ ভাগ মালিকানা সরকারের, ২৫ ভাগ মালিকানা সদস্যদের। আমি বললাম, এটা তো হবে না। চাচ্ছিলাম পুরোপুরি গরিবের মালিকানায় হবে। এখানে সরকারের কিছু থাকবে না। বহু দর–কষাকষির পরে এ আইন সংশোধন করা হলো। সংশোধন করে পাল্টানো হলো। ৭৫ ভাগ সদস্যদের, ২৫ ভাগ সরকারের।
আইন সংশোধনে সন্তোষ প্রকাশ করে ইউনূস বলেন, এমনভাবে আইন হলো, সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করবে বোর্ড। সদস্যদের প্রতিনিধি ও সরকারের প্রতিনিধি বোর্ডে থাকবেন। সেভাবেই চলল। সদস্যদের মালিকানা। এর ওপরে সরকারের আর কোনো কথা চলবে না। শুধু বোর্ডের কথাতে চলবে। হঠাৎ পরবর্তী সময়ে সরকারের শখ হলো যে এটা ওভাবে চলতে দেওয়া যায় না। এটা সরকারের আয়ত্তে আনতে হবে। তারপরই সমস্যা শুরু হয়ে গেল।
ড. ইউনূস বলেন, যদিও ২৫ ভাগ মালিকানা সরকারের, সরকার আর পয়সা দিচ্ছিল না। ওদিকে সদস্যদের বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে। ক্রমে ক্রমে সদস্যদের শেয়ার হয়ে গেল ৯৮ শতাংশ আর সরকারের ২ শতাংশ। এভাবেই চলছিল।
চট্টগ্রাম কলেজিয়েটের সভাপতি ও দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য দেন ১৮০ বছর পূর্তি ও পুনর্মিলনী উদ্যাপন পরিষদের আহ্বায়ক আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী এবং সদস্যসচিব মোস্তাক হোসাইন।