ক্রীড়া ডেস্ক : নিউজিল্যান্ডে এবারই সবচেয়ে ভালো খেলল বাংলাদেশ দল। চমকে উঠলেন? টানা তিন ম্যাচে হেরে হোয়াইটওয়াশ —এটাকে ভালো বলা হচ্ছে কেন!
আসল কথায় যাওয়ার আগে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশ দলের আগের দুটি দ্বিপক্ষীয় ওয়ানডে সিরিজে ফিরে তাকানো যাক।
২০০৭ সফরেও তিন ওয়ানডেতেই হার। দুই শর ওপরে (২০১) রান শুধু
প্রথম ওয়ানডেতে। পরের ম্যাচে ১৮১ ও শেষ ওয়ানডেতে ৯৩ রানে অলআউট হয়ে মাত্র ৬ ওভারের মধ্যে হারের লজ্জা।
নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশ তাদের পরের ওয়ানডে সিরিজটি খেলে ২০১০ সালে। সেবারও হোয়াইটওয়াশ। আর এই দুই সিরিজেই পুড়তে হয়েছে এক শর বেশি রানের ব্যবধানে হারের জ্বালায়। দু-একটি ম্যাচে বোলাররা বেধড়ক পিটুনিও খেয়েছেন।
সে তুলনায় এবারের সিরিজ তো ভালো! অন্তত একটি ম্যাচে জয়ের সম্ভাবনা জাগানো, প্রথম ওয়ানডেতে ২৬৪ রান করা—অতীতের চেয়ে কিছুটা তো ভালো হয়েছে এবারের পারফরম্যান্স।
বাস্তবতা হলো, ইতিহাস ঘেঁটে সান্ত্বনা খোঁজার দিন অনেক আগেই বিগত। এবারের পারফরম্যান্সকে কেউ ভালো বললে নিজেকেই অপমান করবেন। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে গত দুই বছরে বাংলাদেশ দলের যে অবস্থান তৈরি হয়েছে, প্রশ্ন উঠবে সেটি নিয়েও। ২০১৫ বিশ্বকাপেই প্রমাণ হয়ে গেছে যে নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনেও বাংলাদেশ লড়াই করতে পারে। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জয় এবং মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরির সুবাদে নিউজিল্যান্ডের সামনে লড়াই করার মতো লক্ষ্য (২৮৮) দিয়ে ভালো খেলার সামর্থ্য বুঝিয়ে দেওয়া গেছে।
বিশ্বকাপের পরের দুই বছর ঘরের মাঠে নতুন যুগের ক্রিকেটই খেলেছে বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ে, পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড—মাশরাফি বিন মুর্তজার দলের সামনে থরথর কেঁপেছে সবাই। সেই বাংলাদেশ বিদেশের মাটিতে ভালো দল হয়ে ওঠার প্রথম চ্যালেঞ্জেই এভাবে ফেল মারবে, সেটা অপ্রত্যাশিত। কন্ডিশনের ভিন্নতাও এখানে বিবেচ্য নয়, কারণ সম্ভবত এবারই প্রথম নিউজিল্যান্ডে এসে এত ভালো ব্যাটিং-সহায়ক উইকেট পেয়েছে বাংলাদেশ দল। যে উইকেটকে তামিম ইকবাল বলেছেন, ‘স্বপ্নের মতো’, মাশরাফির চোখে, ‘আমাদের দেশের চেয়েও ভালো।’
ব্যর্থতার কারণ আসলে একটাই—বাজে ক্রিকেট। স্রেফ বাজে ক্রিকেট। আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলা যায়, খেলোয়াড়দের নিজেদের সামর্থ্যের প্রতি অবিচার করা এবং কারও কারও খেয়ালি মনোভাব। বিশেষ করে দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দের দায়িত্ব নিয়ে খেলার মানসিকতার অভাব প্রকটভাবে ধরা পড়েছে সিরিজে। এমন কোনো পারফরম্যান্স বা এমন একজন খেলোয়াড়কে খুঁজে পাওয়া যায়নি, যাঁর খেলায় দলের গত দুই বছরের পারফরম্যান্সের ছবি ফুটে উঠেছে। খেলাটা যেন তাঁদের কাছে নিজের জন্য সীমাবদ্ধ, দলের প্রয়োজনে নয়।
মাশরাফিও কাল সংবাদ সম্মেলনে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এ কথাই বলতে চেয়েছেন। যার সারমর্ম, ক্রিকেটীয় দক্ষতায় এই সিরিজে বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডের কাছাকাছিই ছিল। ঘাটতি আত্মনিবেদনে। আর সে রকমটি হলে ওয়ানডে সিরিজের ব্যর্থতাকে শুধু ক্রিকেটীয় ধরে নিয়ে বসে থাকাটা ভুল হবে।
নিউজিল্যান্ড সিরিজের জন্য বাংলাদেশ দলের প্রস্তুতি নিয়েও শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। বিপিএলের পরপর একগাদা ক্রিকেটার নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে নয় দিন অনুশীলন করালেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে, যার খরচ প্রায় কোটি টাকা। টাকাটা নয়, প্রশ্ন চিন্তায়। দল খেলবে নিউজিল্যান্ডে, প্রস্তুতি ক্যাম্প কেন অস্ট্রেলিয়ায়? আর সেই প্রস্তুতিতে ২২ জন ক্রিকেটার কেন? সবাই জানে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে মিল তেমন একটা নেই। তারপরও অস্ট্রেলিয়ায় ক্যাম্প করার যুক্তি, সেখানে সুযোগ-সুবিধা ভালো। কিন্তু নিউজিল্যান্ডে এসে দেখা গেল, এখানেও এখন ক্রিকেট অনুশীলনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা চলে এসেছে। নেলসনের স্যাক্সটন স্পোর্টস কমপ্লেক্সের ইনডোরেই সম্প্রতি যুক্ত করা হয়েছে অনুশীলনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। পয়সা খরচ করে বাড়তি অনুশীলন যদি করতেই হয় সেটা অন্য দেশে না করে যে দেশে সিরিজ, সেখানে গিয়ে করাটাই কি বুদ্ধিমানের কাজ হতো না?
কন্ডিশনটা শেষ পর্যন্ত সমস্যা হয়নি বলে সেটি বিশদভাবে আলোচিত নাই-বা হলো। কিন্তু হ্যামেিলনের বাঁশিওয়ালার মতো কেন ২২ জন ক্রিকেটারকে নিয়ে এ দেশ থেকে ও দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন হাথুরুসিংহে? আর কোচ চাইলেই কেন এ রকম অদ্ভুত ইচ্ছায় সাড়া দিতে হবে? বিসিবির কি তাঁর ওপর কোনো কর্তৃত্ব নেই? বিশাল বহর নিয়ে ঘোরায় যে আদৌ সুফল নেই, সেটা এখন অন্তত বুঝতে পারার কথা বিসিবির। সাফল্যের স্রোতে ভাসমান দলটার ধবলধোলাই হওয়ার পর!
ছোটখাটো কিছু ঘটনায় এটাও পরিষ্কার, বাড়তি ক্রিকেটারের বহর দলের মধ্যে শুধু অস্বস্তির বাষ্পই ছড়ায়। অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু দল নির্বাচনের বিশৃঙ্খল চিত্রটাই দেখুন। সিরিজের তিন ওয়ানডের জন্যই ভিন্ন ভিন্ন ১৫ সদস্যের দল ঘোষণা করা হয়েছে। এক ম্যাচে ১৫ জনের দল দেওয়ার আগেই চূড়ান্ত হয়েছে একাদশ! কোচ-নির্বাচকদের এমন এলোমেলো চিন্তার কারণ হতে পারে দুটি। হতে পারে অনেক খেলোয়াড়ের সামর্থ্য সম্পর্কেই তাঁদের সঠিক ধারণা নেই। একেকবার একেকজনকে তাই গিনিপিগ বানানো। অথবা কোচ-নির্বাচকেরা সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম। তাঁরা নিজেরাও জানেন না কোনটি সেরা দল। এতে খেলোয়াড়দের ওপরও একটা মানসিক চাপ থাকে।
আর এভাবে দল ঠিক করতে হলে নির্বাচক বা কোচ না হলেও চলে। হাতে ১৮-২০ জন খেলোয়াড় রেখে একবার এই ১৫ জন, আরেকবার ওই ১৫ জন নেওয়াই যদি দল নির্বাচনের প্রক্রিয়া হয়, সেটা তো ইলেকট্রনিক পণ্যের শোরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে টিভিতে খেলা দেখা দর্শকেরাই করে দিতে পারেন! এর জন্য ‘বিশেষজ্ঞ’ হওয়ার দরকার কী?
এত ক্রিকেটারকে একসঙ্গে সামাল দেওয়াটাও অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। এর চেয়ে মুমিনুল হক, তাইজুল ইসলাম, শুভাগত হোম চৌধুরীরা দেশে জাতীয় লিগ খেললেই বেশি ভালো হতো। টেস্টের আগে অন্তত কয়েকজন ক্রিকেটার দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটের মধ্যে থাকতেন।
ফুটবলে ২২-২৩ জনের দল হয়, কিন্তু ক্রিকেটে উন্নত কোনো দেশও আজ পর্যন্ত এত খেলোয়াড় নিয়ে বিদেশ সফরের বিলাসিতা দেখিয়েছে কি না সন্দেহ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড সফরের বাংলাদেশ দলকে তাই ‘দল’ না বলে ‘কন্টিনজেন্ট’ বলাই ভালো। আপাতত ব্যর্থ এই ‘কন্টিনজেন্টে’র শেফ দ্য মিশন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে।
সুত্র : প্রথম আলো