প্রতিবেদক : গত বুধবার রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। শত শত কিশোরী-নারী ও পুরুষের এক সমাবেশ ঘটেছিল সেদিন সেখানে। তাঁদের সবার মুখে ছিল এক কথা—কোনো অবস্থায়ই ১৮-এর আগে বিয়ে নয়। তাঁদের হাতে ছিল নানা স্লোগানসংবলিত ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন। এর কোনোটিতে লেখা ছিল ‘কন্যার বিয়ের বয়স শর্তহীন ১৮ চাই’, কোনোটিতে ছিল ‘বিশেষ বিধান বাতিল কর, শিশু অধিকার নিশ্চিত কর’, আবার কোনোটিতে লেখা ছিল ‘নিরাপত্তা চাই, অপরিণত বয়সে বিয়ে চাই না’। প্রস্তাবিত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের বিশেষ বিধান বাতিলের দাবিতে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি এই সমাবেশের আয়োজন করে। এতে যোগ দেয় দেশের ৬৯টি নারী, মানবাধিকার ও বেসরকারি সংস্থা এবং পাঁচটি জোট।
কোনো প্রস্তাবিত আইনের বিশেষ বিধান বাতিলের দাবিতে এমন সমাবেশ সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে দেখা যায়নি। এই সমাবেশ একটু হলেও আমাদের মনে আশার আলো জাগিয়েছে। দেশে অহরহ বাল্যবিবাহ হয়ে চললেও এর বিরুদ্ধে যে একটি জোরালো প্রতিবাদও রয়েছে, এই সমাবেশের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হলো।
মেয়েদের বিয়ের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছর রেখে গত নভেম্বরে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এতে বিশেষ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশ এবং মা-বাবার সম্মতিতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরও বিয়ের সুযোগ রয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের এই বিশেষ বিধানে বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশনাক্রমে এবং মাতা-পিতার সম্মতিক্রমে বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।’ আইনের এই বিশেষ বিধান নিয়ে আপত্তি শহীদ মিনারের সমাবেশে আসা মানুষদের। তাদের অধিকাংশই কিশোরী। এ ছাড়া যোগ দেন কিশোরীদের অভিভাবকেরা, বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া নারী ও সমাজের বিশিষ্টজনেরা। তাঁদের বক্তব্য ছিল আইনের এই বিশেষ বিধানের সুযোগ নিয়ে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হবে। কাজেই এই বিধান বাতিল করতে হবে।
তাঁদের ভয় হয়তো অমূলক নয়। কিন্তু আমাদের চারপাশে ইদানীং যা ঘটে চলেছে, তাতে মনে হচ্ছে, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের এই বিশেষ ধারা তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। সামাজিক এই অনাচারের বিরুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ তো রয়েছেই। এ ছাড়া মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের বাল্যবিবাহ বন্ধ করে দিচ্ছে। এটাই সবচেয়ে বড় আশার কথা।
গত বছরের মাঝামাঝি সময়। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী ইউনিয়নের কেএনবি উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী শাবানাকে (১৬) বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় তার পরিবার। শাবানা তার বাবা-মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের বোঝানোর চেষ্টা করে যে তার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! পাত্র পছন্দ করে বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক করে ফেলে তার পরিবার। উপায় না পেয়ে নিজের মাথা ন্যাড়া করে ফেলে শাবানা। পাত্রীর ন্যাড়া মাথা দেখে বরপক্ষ বিয়ে ভেঙে দেয়।
গত ডিসেম্বর মাসে বরগুনার আমতলী উপজেলার উত্তর টিয়াখালী গ্রামের সাবিহা ইসলামের (১৬) বিয়ের আয়োজন করেছিলেন তার বাবা-মা। উপায় না পেয়ে বর আসার আগেই মেয়েটি একটি বেসরকারি সংস্থার এক নারী কর্মীকে ফোন করে পুরো বিষয়টি খুলে বলে সহায়তা চায়। ওই নারী কর্মী তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও ভূমি কমিশনারকে জানান। পরে তাঁরা ঘটনাস্থলে এসে বিয়ে বন্ধ করেন।
একই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার রেজিয়া খাতুন (১৫)। বিয়ের দিন সে পালিয়ে চলে আসে ঢাকায় বোনের বাসায়। এখন একটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় পড়ালেখা করছে রেজিয়া। এ রকম আরও ঘটনা ঘটেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এসব ঘটনা সরকার ও অভিভাবক উভয়ের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে।
এসব ঘটনায় মনে হয় সরকার প্রস্তাবিত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে যতই বিশেষ ধারা রাখুক, তাতে কিছু যায়-আসে না। শাবানা, সাবিহা আর রেজিয়াদের দেখে মনে আশা আর সাহস জাগে আর এটা বুঝতে পারি যে প্রতিরোধই সমাধান। এভাবে ঘরে ঘরে যদি প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, তাহলে দেশে একসময় বাল্যবিবাহ বলে কিছুই থাকবে না। তবে আইনেরও প্রয়োজন আছে। তবে সে আইনকে হতে হবে কার্যকরী আইন। বাল্যবিবাহ দেওয়ার সুযোগ থাকতে পারে—এমন কোনো বিধান রাখা যাবে না সে আইনে। ৮ ডিসেম্বর আইনটি বিল আকারে সংসদে উত্থাপিত হয়। বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। আমরা আশা করছি, বিশেষ বিধান বাদ দিয়ে আইনটি পাস করা হবে।
সুত্র : প্রথম আলো