ডেস্ক রিপোর্ট : দেশের নানা প্রান্তের হাওর, বাঁওড়, বিল, হ্রদসহ অসংখ্য জলাশয় এখন অতিথি পাখির স্বর্গরাজ্য। পাখিদের এমনই কয়েকটি আবাসের কথা রইল আপনার জন্য। ‘বুনো হাঁস পাখা মেলে শাঁই শাঁই শব্দ শুনি তার; এক–দুই–তিন–চার–অজস্র–অপার’।
জীবনানন্দ দাশের কবিতার এ পঙ্ক্তির চেয়ে অনেক বেশি আর নানা প্রজাতির রংবেরঙের পরিযায়ী পাখি আর হাঁসেরা ঝাঁক বেঁধে শাঁই শাঁই শব্দ করে ওড়াউড়ি করছিল হাকালুকি হাওরে। উড়তে উড়তে কিছু পাখি শিস দেয় আর কিচিরমিচির করে আবার কিছু পাখি দল বেঁধে বহুদূরে হাওরের ঠিক মাঝখানে পানি কেটে এগিয়ে চলে কিংবা কোনো পাখি আপন মনে সাঁতার কাটে। এ এক অদ্ভুত স্থান, যেন কোনো পাখিরালয়।
‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল’
ভোর পাঁচটা। গত বুধবার। তখনো হাওর পারের মানুষের ঘুম ভাঙেনি। হাকালুকি হাওরের বুকে কুয়াশা জমে রয়েছে। আকাশ থেকে টুপটাপ শিশির ঝরছে। হাত পাতলে হাত দেখা যায় না, এমন অবস্থা। ঠিক এ রকমই কনকনে ঠান্ডায় কেবল পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনা যায়, দেখা যায় না কিছুই। ঘণ্টা দুয়েক পর সকাল সাতটার দিকে যখন সূর্যের কিছুটা দেখা মেলে, তখন পরিযায়ী পাখিরা যেন চারদিকে ‘এঞ্জিনের মতো শব্দে; ছুটিতেছে ছুটিতেছে তারা’। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গায়ে-ডানায় বরফ জড়িয়ে আসা এসব পাখির হাওরের মুক্ত আকাশে অবাধ বিচরণে মুহূর্তেই অন্য এক রূপ নেয় গোটা এলাকা।
হাওরের পানিতে ভাসছে শত শত পাখির ঝাঁক। স্থানীয় মানুষের মতে, এবার হাওরে বালিহাঁস, ভুতি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, সরালি, গুটি ইগল, কুড়া ইগল, কাস্তেচড়া, পান ভুলানি, কালিম, টিটি, পেডিসহ অন্তত ১৫ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি এসেছে। তবে এর মধ্যে বালিহাঁসের আধিক্যও বেশি। এসব পরিযায়ী পাখি ছাড়াও সাদা বক, কানি বক, পানকৌড়ি, চিল, বাজপাখিসহ দেশীয় প্রজাতিরও নানা পাখি রয়েছে। অধিকাংশ পাখি কুয়াশা ছিঁড়ে পানিতে নানা কায়দায় শারীরিক কসরত করছে। কিছু পাখি লেজ দুলিয়ে পোকা খুঁটে খাচ্ছে। শিকার শেষে কিছু সাদা বক খুঁটিতে বসে জিরিয়েও নিচ্ছে। যত আলো বাড়তে থাকে, পাখিরাও তত লোকালয় থেকে আরেকটু দূরে হাওরের ঠিক মাঝখানে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে থাকে।
পাখির অস্থায়ী আবাস
হাকালুকি হাওর কেবল দেশের সবচেয়ে বড় হাওর নয়, এটি এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ মিঠাপানির জলাশয় হিসেবেও পরিচিত। এর আয়তন ১৮ হাজার ১১৫ হেক্টর। মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার পাঁচটি উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত। এর মধ্যে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় ৪০ শতাংশ, কুলাউড়া উপজেলায় ৩০ শতাংশ, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় ১৫ শতাংশ, গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ১০ শতাংশ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় ৫ শতাংশ অংশ রয়েছে। এ হাওরে ছোট-বড়-মাঝারি সব মিলিয়ে ২৩৮টি বিল রয়েছে বলে জেলা তথ্য বাতায়নে উল্লেখ রয়েছে। তবে হাওরের বাইয়া, হাওরখাল, গজুয়া, রঞ্চি ও কালাপানি জলাশয়েই পাখির আধিক্য বেশি থাকে বলে স্থানীয় লোকেরা জানিয়েছেন। মৌলভীবাজার জেলা তথ্য বাতায়নে উল্লেখ রয়েছে, গত শীত মৌসুমে এ হাওরে ৪৮ প্রজাতির প্রায় এক লাখ পাখি এসেছিল।
এবার কত পাখি এসেছে হাওরে?
হাওরে কত প্রজাতির কতসংখ্যক পাখি এসেছে, এটি জরিপ করতে ২৩ ও ২৪ জানুয়ারি পাখিশুমারি হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিএনআরএসের (ন্যাচারাল রিসোর্চ ম্যানেজমেন্ট স্টাডি) স্থানীয় মাঠ ব্যবস্থাপক মো. হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, প্রতিবছর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে হাকালুকি হাওরের পানি শুকিয়ে যায়। আর পানি শুকিয়ে গেলেই পরিযায়ী পাখিরা এসে ভিড় করে। গত বছর অন্তত কয়েক লাখ পাখি এসেছিল। তবে গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পানি শুকানোর কারণে এখন পাখিরা কেবল আসতে শুরু করেছে। সপ্তাহখানেক বাদে পুরো হাওর পাখিময় হয়ে দাঁড়াবে। তবে এ পর্যন্ত প্রায় লাখখানেক পাখি এসেছে বলে তাঁর ধারণা।
হাকালুকি হাওরের ঠিক পাশেই যুধিষ্ঠিপুর গ্রাম। ওই গ্রামের বাসিন্দা ওয়াহিদ হোসেন নানু (৪২) বলেন, গত বছর হাকালুকি হাওরের ধানের জমি অকালে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় হাওরের সবখানেই খাবার রয়েছে। তাই পাখিরা নির্দিষ্ট কোনো স্থানে ভিড় না করে পুরো হাওরজুড়েই বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করছে। হাওরের নিভৃত স্থানেও খাবার থাকায় বিল-জলাশয়ের পাড় ঘেঁষে এবার তাই পাখিরা খুব একটা জড়ো হচ্ছে না। তবে সকালে ও বিকেলে পাখিদের ওড়াউড়ি বেশি থাকে। অন্যান্য বছরের চেয়ে তুলনামূলকভাবে পরিযায়ী পাখি কম এলেও এ মাসের শেষ দিকে পাখির সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
প্রথম আলো