1. sardardhaka@yahoo.com : adminmoha :
মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ ২০২৩, ০৯:০৭ পূর্বাহ্ন

‘ইয়াহিয়া বললেন, খেলা শেষ’

মহাযুগ নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ৫ মার্চ, ২০১৭
  • ৩৫৪ বার

একাত্তরের ঘটনাবলি পাকিস্তানের একেক কুশীলব একেকভাবে দেখেছেন। ব্যাখ্যা করেছেন। সিদ্দিক সালিক ও আরশাদ সামি খান দুজনই ছিলেন পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তা। কিন্তু তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সিদ্দিক সালিক ছিলেন ঢাকায় আর সামি খান রাওয়ালপিন্ডিতে। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকের বর্ণনা দিতে গিয়ে সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘জেনারেল নিয়াজি ১৪ ডিসেম্বর রাও ফরমান আলীকে সঙ্গে নিয়ে মার্কিন কনসাল জেনারেল স্পিভাকের কাছে যান এবং যুদ্ধবিরতির শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা করার অনুরোধ জানান। কিন্তু স্পিভাক জানিয়ে দেন যে তিনি তাঁদের পক্ষ নিয়ে আলোচনা করতে পারবেন না, বার্তাটি পাঠিয়ে দিতে পারেন মাত্র।
জেনারেল নিয়াজি চেয়েছিলেন, প্রস্তাবটি ভারতের সেনাপ্রধান স্যাম মানেকশর কাছে পাঠানো হোক। কিন্তু স্পিভাক পাঠিয়েছেন ওয়াশিংটনে। মার্কিন সরকার ভারতের কাছে পাঠানোর আগে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পরামর্শ করার চেষ্টা করে, কিন্তু ইয়াহিয়া খানকে পাওয়া যাচ্ছিল না। সিদ্দিক সালিক জানাচ্ছেন, ইয়াহিয়া ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং আর অফিসে আসেননি। তাঁর সামরিক সচিব মানচিত্রের মাধ্যমে তাঁকে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতেন। একবার সেই মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমি কী করতে পারি?’
১৬ ডিসেম্বর লাখ লাখ বাঙালির উপস্থিতিতে তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজি বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। নিয়াজি প্রথমে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানালে ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা তাঁর অবস্থানে অনড় থেকে বলেন, ‘এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’ তখন নিয়াজি যৌথ বাহিনীর কাছেই আত্মসমর্পণ করেন।
যুদ্ধ আরও কয়েক দিন প্রলম্বিত করতে পারতেন কি না, পরে সিদ্দিক সালিক জিজ্ঞেস করলে নিয়াজি জবাব দেন, ‘তাতে আরও বেশি মানুষের মৃত্যু ও সম্পদ ধ্বংস হতো। নগরজীবন অচল হয়ে যেত। মহামারি ও অন্যান্য ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু পরিণতি একই হতো। এরপর তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, ‘আমি ৯০ হাজার বিধবা ও ৫০ লাখ এতিমের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে এখন ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দী পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাচ্ছি।’
এর আগের একটি ঘটনা। যুদ্ধে পরাজয় এড়ানোর জন্য পাকিস্তান তখন মরিয়া। ইয়াহিয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে সহায়তা চেয়ে বার্তা পাঠালেন। পাকিস্তান সময় রাত দুইটায় নিক্সন যখন টেলিফোন করেন, ইয়াহিয়া তখন নিদ্রামগ্ন। তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলে দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে কথোপকথন হয়। নিক্সন পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান এবং বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর নির্দেশ দেন। দুই নেতার টেলিফোন সংলাপ শেষ হওয়ার পর উদ্দীপ্ত ইয়াহিয়া জেনারেল হামিদকে টেলিফোনে লাগিয়ে দিতে বলেন। ইয়াহিয়ার মতো সামিও তখন উদ্দীপ্ত।
ইয়াহিয়া বললেন, ‘হামিদ, আমরা এটা করেছি। আমেরিকানরা পথে আছে।’ এরপর সামির মন্তব্য, ‘পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ও জীবনহানি সত্ত্বেও সেই আমেরিকান নৌবহর আর আসেনি, এমনকি ঢাকা পতনের পরও নয়।’ তাঁর কাছে ঢাকার পতন এবং আত্মসমর্পণ ছিল একটি দুঃখজনক অভিজ্ঞতা। তিনি বলেছেন, ‘আমি কেঁদেছি এবং আমাদের টিমের আরও অনেকেই কেঁদেছে। পরাজিত ও অবমাননার বোধ তাড়িত করেছিল আমাদের। এসব যখন আমাদের সঙ্গে ঘটছে, আমরা তখন তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সামি ভেবেছেন, সেটি ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন এবং তা একসময় কেটে যাবে।
কিছুক্ষণ পর তাঁর বোধোদয় হলো, এটি কোনো দুঃস্বপ্ন ছিল না। প্রতিদিনের সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মতো ধ্রুব সত্য।
ভুট্টো বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে যে কমিশন গঠন করেছিলেন, সেখানে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সামি খান তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। সেটি অবশ্য নিজের জন্য নয়। তিনি যার এডিসি ছিলেন, সেই পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জন্য। কমিশনের প্রধান তাঁকে বহু নারীর নাম উল্লেখ করে জানতে চান, ‘স্কোয়াড্রন লিডার, আপনি এঁদের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিয়েছেন, আপনি কি বলতে পারেন, তাঁরা ভেতরে যাওয়ার পর কী হয়েছে? মনে রাখবেন, আপনি শপথ নিয়েছেন।’
এই প্রশ্নে সামি খান বিরক্ত হলেও মাথা ঠান্ডা করে বললেন, ‘এখানে দুটি বিষয় আছে, প্রটোকল ও নিরাপত্তা। এডিসি হিসেবে যাঁরা সাক্ষাতের সময় ঠিক না করে আসেন, তাঁদের বিষয়টি দেখা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আপনি স্মরণ করে দেখতে পারেন, অনুমতি নিয়ে অনেকবার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু ভেতরে প্রেসিডেন্ট ও আপনার মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছে, সেটি আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। প্রেসিডেন্ট ও আপনি যেসব নারীর কথা বললেন, তাঁদের মধ্যে কী হয়েছে, তা–ও আমার জানার কথা নয়।’
দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, জেনারেল ইয়াহিয়া সব সময় মদ খেতেন। আপনি কী বলতে পারেন দিনে কী পরিমাণ মদ তিনি খেতেন?
সামি উত্তর দিলেন, ‘স্যার, আপনি ভুল লোককে প্রশ্ন করেছেন। আমি তাঁর মদ পরিবেশনকারী ছিলাম না। আপনি যদি এই প্রশ্নের উত্তর চান তাহলে বার বয় বা হাউস কম্পট্রোলারের কাছে জিজ্ঞেস করুন।’
নিয়াজির বার্তা পেয়ে ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং ঢাকার পরাজয়কে দুঃখজনক ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন,
এই বিপর্যয় সাময়িক এবং পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। কিন্তু প্রেসিডেন্টের ভাষণের মূল রূপরেখা অনেক দিন আগেই তৈরি করে রাখা হয়েছিল।
এরপর ইয়াহিয়া জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে এই বার্তা পাঠান যে, পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছে এবং ভারতকেও এটি মানতে হবে। তিনি এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সহযোগিতা চান।
তখনো পশ্চিম পাকিস্তানের ৫ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ড এবং ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দীর বিষয়টি জনগণকে জানানো হয়নি। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে জয়ী না হয়েও যেভাবে জনগণকে বোঝানো গিয়েছিল, এবার আর সেটি সম্ভব হচ্ছে না। এর অর্থ হলো, জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তাঁর সহযোগীদের বিদায়। জেনারেলদের সঙ্গে ইয়াহিয়ার বৈঠকের মাঝখানেই জানা গেল সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে।
এই প্রেক্ষাপটে ইয়াহিয়া তাঁর এডিসি সামি খানকে লক্ষ করে বললেন, ‘শোনো, ব্রিগেড বিদ্রোহ করেছে, এ খবর সত্য হোক বা না হোক, খেলা শেষ।
২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টো দেশে ফিরে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে শপথ নেন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।

প্রথম আলো থেকে নেয়া

এ জাতীয় আরো সংবাদ
© All rights reserved © 2020 Mohajog