1. sardardhaka@yahoo.com : adminmoha : Sardar Dhaka
  2. nafij.moon@gmail.com : Nafij Moon : Nafij Moon
  3. rafiqul@mohajog.com : Rafiqul Islam : Rafiqul Islam
  4. sardar@mohajog.com : Shahjahan Sardar : Shahjahan Sardar
শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৫:৪২ পূর্বাহ্ন

যে রোগে তরুণীকে অন্তঃসত্ত্বার মতো দেখায়

মহাযুগ নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১৭ জুলাই, ২০১৮
  • ৩৪২ বার

মর্জিনার বয়স আর কত হবে। এই ধরেন তের কী চৌদ্দ বছর। প্রথম যখন মাসিক হয়েছিল খুব ভয় পেয়েছিল। গোপন কথাটা মাকে জানায়। মা-ই তাকে বুঝিয়ে বলেন, ‘মেয়েদের এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতি চার সপ্তাহ পরপর দুই তিন দিন অল্প অল্প রক্তস্রাব হবে। এটা মেয়েদের সাবালক হবার লক্ষণ।’

এই সময় পর থেকেই মেয়েরা বিয়ে করলে সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে ১৮ বছর পূর্ণ না হলে মেয়েরা বিয়ে বা সন্তান নেয়ার জন্য পূর্ণভাবে প্রস্তুত হয় না।

মা তাকে পিরিয়ডকালীন স্বাস্থ্যসম্মত থাকার সব নিয়ম কানুন শিখিয়ে দেন। এখন থেকেই ছেলে বন্ধুদের থেকে একটু দূরে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। স্কুলে যাওয়ার সময় পাড়ার বখাটে দুই ছেলে খল্কু কাদের ও মুরগী কাদের রাস্তায় উত্যক্ত করে। তাদের থেকে সাবধান থাকতে বলেন।

মর্জিনা বেশ সুন্দরী ও আকর্ষণীয়া। তাই মা তাকে হিজাব পরান। অজপাড়া গাঁয়ে বাড়ি হওয়ায় রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়। একা একা মেয়েদের এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তারা দলবদ্ধ হয়ে স্কুলে যাতায়াত করে।

হঠাৎ মাঝে মাঝে একা একা যেতে হয়। তখন আত্মাটা হাতে নিয়ে পার হয় এই ঝোপঝাড়। কখন কোন বখাটে এসে সামনে দাঁড়ায়, জড়িয়ে ধরে সেলফি তোলার নামে অসভ্যতা করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। এ নিয়ে মর্জিনা থাকে আতংকে।

মর্জিনা ক্লাস এইটে পড়ে। তার ছোট ভাইটি ক্লাস ফোরে পড়ে। বাবা সৌদি আরব চাকরি করেন। কোনমতে এসএসসি পাস করেছিলেন। ছোটবেলায়ই বাবা হারান মর্জিনার বাবা গফুর মিয়া।

গফুর মিয়ার বাড়ি ভিটা ও পালানের ক্ষেতটি ছাড়া আর কোন জমিজমা নাই। তাতে সংসার চলতো না। চাকরি নেবার চেষ্টা করেছেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু ঘুষ ছাড়া চাকরি পাওয়া বড় দুষ্কর। কোম্পানির চাকরি পাওয়া যায়। কিন্তু তাতে বেতন কম, খাটুনি বেশি এবং বউ বাচ্চা রেখে দূরে থাকতে হয়। তাই তিনি কোম্পানির চাকরি নেন না।

গ্রামে আছে টাকা লোন দেয়ার সমিতি। কয়েকজন প্রবাসী ও দেশী মিলে এই সমিতি করেছে। সমিতির নাম দিয়েছেন ‘গরিবের বন্ধু।’ গরিবের বন্ধু গরিব যুবকদের চড়া সুদে টাকা ধার দেন বিদেশ যাওয়ার জন্য। কাজেই টাকা কোন সমস্যা না। বিদেশ যাবেন? টাকা লাগবে? দিবে গরিবের বন্ধু।

গরিবের বন্ধুরা খোঁজেন কোন কোন ছেলে একটু একটু দাড়ি গোফ উঠা শুরু করেছে। এদের বাবাকে পটিয়ে ফেলেন বিদেশ পাঠাতে। বিদেশ পাঠাতে পারলে গরিবের বন্ধুদেরই লাভ বেশি। আগের দিনে এরকম ছেলে সন্ধান করতো ঘটকরা।

তখন বাল্যবিয়ের হিড়িক ছিল। মোটা অংকের টাকা যৌতুক নিয়ে ছোট ছোট ছেলেদেরকে বিয়ে দিয়ে দিত। এখন এখন তারা পড়ালেখা বাদ দিয়ে বিয়ে না করে বিদেশ চলে যায়। এদিকে মেয়েরা পড়া চালিয়ে যায়। কাজেই মর্জিনাদের গায়ে ছেলেদের থেকে মেয়েরাই বেশি শিক্ষিত।

গফুর মিয়া গরিবের বন্ধু থেকে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়ে সৌদি আরব চাকরি করতে গেছেন প্রায় তিন বছর হয়। বেতন যা পান তার বেশিরভাগই ঋণের কিস্তি শোধ করতে চলে যায়।

বাকি টাকায় কোন মতে মর্জিনার মা সংসার চালান। গফুর মিয়ার ইচ্ছা হয় একবার দেশ থেকে ঘুরে আসার। কিন্তু বিমান ভাড়ার টাকা নেই তার কাছে। কতদিন ছেলেটাকে বুকে নিয়ে আদর করা হয় না। কতদিন মর্জিনাকে আদর করা হয় না। অল্প অল্প রিয়েল সে জমা করছিল বিমান ভাড়ার জন্য।

এদিকে মর্জিনার একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। সে অনুভব করল তার তলপেটটা কেমন যেন ভারী হয়ে যাচ্ছে। বোরখা পড়ে স্কুলে যায়। তাই বাইরে থেকে দেখা যায় না।

বান্ধবীরা বলে,‘মর্জিনার তলপেট এমন বড় হয়েছে যে দেখে যেন মনে হয় চার মাসের বাচ্চা পেটে।’

মর্জিনা লজ্জা পায়। মর্জিনার মা বলেন “গেদি, তুই তো বেশি খাসও না। পেট বড় হচ্ছে কেন?” মর্জিনা লজ্জা পায়।

মর্জিনার তলপেট বড় হতেই লাগলো। বোরখার উপর দিয়েও দেখা যাচ্ছিল। সবাই কেমন যেন পেটের দিকে চেয়ে থাকে। দুশ্চিন্তায় পরে গেল।

ক্ষুধামন্দ দেখা দিল। বমি বমি ভাব আসে। ঘন ঘন প্রশ্রাবের চাপ আসে। স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল। মায়ের দুশ্চিন্তা হতে লাগলো। মেয়ে কি কোন দুর্ঘটনায় জড়িয়ে পরলো? মা মহাবিপদের আশংকা করলেন।

গোপনে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন- তোর ব্যাপারটা আমার কেমন যেন ভালো মনে হচ্ছে না। আমি তোর মা। আমি তোর সব সময় ভালো চাই। কোন দুর্ঘটনা হয়ে থাকলে আমাকে খুলে বল। সময় মতো না বললে মহাবিপদে পড়ব আমরা। সমাজে মুখ দেখাতে পারব না।

: মা। আল্লাহ সাক্ষী। খারাপ কিছু না। কেন যে এমন হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না।

: সন্তান পেটে আসার সব লক্ষণ দেখছি। আল্লাহ্‌ মালুম।

মর্জিনার রাতে ঘুম হয় না। সে ধর্ম শিক্ষা বইয়ে পড়েছে “মরিয়ম (আ:) কুমারী সতী মেয়ে ছিলেন। আল্লাহ্‌র নির্দেশে তার পেটে সন্তান আসে স্বামী ছাড়াই। সমাজ তাকে অপবাদ দেয়। তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। অবশেষে তার পেট থেকে জন্ম নেন এক পবিত্র শিশু। যিনি হলেন নবী ঈসা (আ:)।” আল্লাহ্‌ কি আমাকে কোন বিপদে ফেলছেন? মনে মনে ভাবেন মর্জিনার মা।

এলাহি মেম্বার ও খইরা মেম্বার এই গ্রামের দুইজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। দুইজনই কিছুটা খারাপ প্রকৃতির। তার মধ্যে এলাহি মেম্বার মন্দের ভাল। দুইজন পাল্টাপাল্টি ইলেকশন করেন। একজন আরেকজনের শত্রু। একেকবার একেকজন মেম্বার হন। বর্তমান মেম্বার এলাহি।

সবসময় একজন আরেকজনকে ঘায়েল করতে চান। মর্জিনার ব্যাপারটা তাদের কানে গেল। খইরা মেম্বার মর্জিনার মায়ের কাছে গোপনে প্রস্তাব দিলেন

: আপনার মেয়ে শক্ত অন্যায় করেছে। শক্ত বিচার হবে। যার সাথে মেলামেশা করেছে তার নাম বলতে হবে। তার সাথেই বিয়ে দিয়ে দেব। আর যদি এলাহি মেম্বারের নাম বলতে পারেন তবে দুই লাখ টাকা পাবেন। ভেবে দেখুন!

: আমার মেয়ে কোন অন্যায় কাজ করে নাই। আল্লাহই জানেন তার কী হয়েছে। মিথ্যা কথা বলে মানুষের ক্ষতি করতে পারব না।

এলাহি মেম্বারের কানে গেছে যে খইরা মেম্বার তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। তিনি মর্জিনার মাকে গোপনে প্রস্তাব দিলেন

: শুনছি খইরা মেম্বারের কাছ থেকে টাকা খেয়ে আমার নাম বলাইতেছেন। আমি আপনাকে তিন লাখ টাকা দিব। আমার নাম বলবেন না।

: আমরা গরীব হতে পারি, খারাপ না। আমার মেয়ে কোন খারাপ কাজ করে নাই। কারো নাম বলার দরকার নাই। টাকা খাওয়ারও দরকার নাই।

সারা গ্রামে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল ‘গফুর মিয়া বউ বাচ্চা রেখে বিদেশ পড়ে আছে। এদিকে মেয়ে মর্জিনা কেলেঙ্কারি করে ফেলেছে। এর বিচার করতে হবে। একা একা তো এই কাজ হয় নাই। মর্জিনাকে চাপ দিয়ে কথা বের করতে হবে। যার নাম বলবে তার সাথেই তার বিয়ে পড়িয়ে দিতে হবে। নইলে হুজুর ডেকে দোররা মারতে হবে। এমনি এমনি না বললে বাঁশডলা দিতে হবে। বাঁশডলা খেয়ে সব ভেরভেরি বলে দিবে।’

এই কথা মর্জিনার কানে গেল। সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিল। বিস্তারিত জানিয়ে মর্জিনার মা গফুর মিয়াকে ফোন করলেন। গফুর মিয়া ভেঙে পড়লেন প্রবাসে।

মর্জিনা গ্রামের মেয়ে হলেও সে সাঁতার শেখে নাই। সকাল দশটার দিকে বাড়ির দক্ষিণ পাশের পুকুর পাড়ে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল। হঠাৎ পানিতে ঝাঁপ দিয়ে হাবুডুবু খেতে লাগলো।

মর্জিনার ছোট ভাই পুকুর পাড়েই খেলছিল। শব্দ পেয়ে সে দেখলো পানিতে তার বোন হাবুডুবু খাচ্ছে। সে চিৎকার দিয়ে ডাকলো “মর্জিনা আপু পানিতে পড়েছে, বাঁচাও, বাঁচাও।” সবাই দৌড়িয়ে এসে মর্জিনাকে উঠিয়ে আনলো।

কাছ দিয়ে যাচ্ছিল পাড়ার ছেলে নুরুল আমিন। সে মেডিকেল কলেজে পড়ে। এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ছুটিতে বাড়িতে এসেছে।

তাকে সবাই বলল পানিতে পড়া রোগীটাকে চিকিৎসা করাতে। সে খালি হাতে ছিল। তবু যতটুকু পারা যায় সে দেখল। বলল

: ভাল আছে। তেমন সমস্যা নাই।

: পেট ভর্তি পানি। পানি বের করতে হবে না?

: পেটে পানি নেই।

: পানি নেই মানে? পেট এত ফোলা কেন?

: এগুলি পানি না। আমি পারকাশন করে দেখেছি। এটা একটা সেমিসলিড মাস। শহরে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে হবে।

: আমরা বুঝে গেছি। মর্জিনার বাপেরে বিদেশ থেকে খবর দিয়ে এনে এর বিচার করতে হবে।

সবাই চলে গেলে নুরুল আমীন মর্জিনার মাকে বুঝালেন, খুব সম্ভব ওর টিউমার হয়েছে। ময়মনসিংহে নিয়ে গাইনি ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করা দরকার।

মর্জিনা শুনে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত পাল্টালো। চোখ মেলে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নুরুল আমীনকে দেখল। নুরুল আমীন কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল।

মর্জিনার মা মর্জিনার বাবাকে মোবাইলে ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে দিলেন। গফুর মিয়া মেয়ের কানে মোবাইল দিতে বললেন। মর্জিনা বাবাকে কিছু বলল না। শুধু গফুর মিয়াই কথা বললেন

: মারে, তুই খারাপ কিছু করতে পারিস তা আমি বিশ্বাস করি না। পাড়ার খারাপ লোকের কথায় কান দিস না। আমাকে না দেখে তুই মরিস না। আমি টাকা ধার নিয়ে বিমানের টিকিট করে কালই আসছি। আমি তরে বড় ডাক্তার দেখামু। নুরুল আমীন কইছে তোর পেটে টিউমার হতে পারে। অপারেশন করলেই টিউমার ভাল হয়ে যাবে।

দুইদিন পর গফুর মিয়া দেশে ফিরলেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। নুরুল আমীনের কাছে গিয়ে তার সাহায্য চাইলেন। নুরুল আমীন আশ্বাস দিলেন এখন তার কলেজ ছুটি। অসুবিধা নাই।

সেই মর্জিনার সাথে ময়মনসিংহ যেতে পারবে। ময়মনসিংহের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফরিদা ম্যাডামকে দেখাবে। যেহেতু পাড়ার মানুষ আজেবাজে কথা বলছে সেহেতু পাড়ার কয়েকজন সাক্ষী নিয়ে যেতে হবে সাথে। এলাহি মেম্বার, খইরা মেম্বার ও ইমাম সাহেব হুজুরকে নিয়ে যেতে হবে। টিউমার হয়ে থাকলে অপারেশন করে বের করে তাদেরকে দেখাতে হবে।

কথামতো সবাইকে নিয়ে একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে মর্জিনাকে নিয়ে ময়মনসিংহ গেলেন। মর্জিনার মাও সাথে ছিলেন। সব শুনে এবং শরীর পরীক্ষা করে ডা. ফরিদা বললেন

: খুব সম্ভব ওভারিয়ান টিউমার। ডা. মাইদুল ইসলামকে দিয়ে একটা আল্ট্রাসনোগ্রাম করিয়ে নিয়ে আসুন।

মর্জিনার মা বললেন

: মহিলা ডাক্তার দিয়ে আল্ট্রাটা করানো যায় না?

: যায়। তবে কেইসটা ইম্পোর্টেন্ট। মাইদুল সাহেব করলেই বেশি ভাল হবে। ওনার রিপোর্টের ওপর বেশি ভরসা করা যায়।

: মেশিন দিয়েই তো পরীক্ষা হয়। এত বাছা-বাছির কী আছে?

: আছে। যন্ত্রটা টেলিভিশনের পর্দার মতো। আপনারা যখন ছোট বড় সবাই মিলে টেলিভিশন দেখেন সবাই কি সবকিছু সমান বুঝেন?

: না।

: কাজেই, শুধু আল্ট্রাসনো মেশিন থাকলে হবে না। মেশিন দিয়ে কে দেখছেন সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে।

আল্ট্রাসনো করা হল। রিপোর্ট নিয়ে ডা. ফরিদার কাছে গেলেন। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন

: মেয়েটার ওভারিতে টিউমার হয়েছে। এই টিউমার অজ্ঞান করে পেট কেটে বের করতে হবে।

: আজকের মধ্যে কাজটা করা যাবে না?

: আপনারা প্রস্তুত থাকলে আজই সম্ভব।

বিকেল চারটার দিকে অপারেশন সাকসেসফুল হয়ে গেল। হাত ধুয়ে ডা. ফরিদা টিউমারটা বোলে করে নিয়ে এসে সবাইকে দেখালেন। গোল, ফুট বলের মত দেখতে। খইরা মেম্বার বললেন

: ম্যাডাম, আমার সন্দেহ হচ্ছে এটা বাচ্চার থলি। পানি পাত্তাটা কেটে দিলে ভিতরে বাচ্চা পাওয়া যাবে। থলিটা গ্রামে নিয়ে গিয়ে সবার সামনে কাটব।

: গ্রামে নেয়ার কী আছে? আপনারাতো আছেন। আপনাদের সামনেই কাটি।

ধারালো স্কালপেল দিয়ে ডা. ফরিদা টিউমারটি কাটলেন। সাথে সাথে এক গুচ্ছ চুল দেখা গেল থলের ভিতরে। সবাই চমকে গেলেন।

খইরা মেম্বার বারান্দায় গিয়ে গ্রামের পাঁজি লোকদের জানিয়ে দিলেন ‘থলিতে বাচ্চা পাওয়া গেছে। আমি নিজে বাচ্চার চুল দেখেছি।’

এই কথা মোবাইলে জানিয়ে দিয়ে বলে আবার ভিতরে প্রবেশ করলেন। ডাক্তার ভালভাবে থলেটি ওপেন করলেন। দেখা গেল এটা ভর্তি আঠালো পদার্থ। এর মধ্যে লম্বা লম্বা চুল দলা পাকিয়ে আছে। কিছু অংশ মাংসের মত। কিছু অংশ শক্ত। দুইটি দাঁত পাওয়া গেল শক্ত অংশে। এলাহি মেম্বার বললেন

: ব্যাপারটা কী হল? এটা টিউমার? না বাচ্চা?

: এটা টিউমার। এটা টেরাটোমা। এই ধরনের টিউমারে শরীরের যে কোন রকমের টিস্যু থাকতে পারে।

: আমরা গ্রামের মানুষকে দেখানোর জন্য এটা বৈয়ামে করে নিয়ে যাব।

: ফরমালিনের মধ্যে রেখে নিয়ে যেতে পারেন। তবে এর মধ্যে অনেকসময় ক্যান্সার থাকে। সেই জন্য বায়োপ্সি বা হিস্টোপাথলজিক্যাল পরীক্ষা করাতে হবে। ডা. সাকিবকে দিয়ে এই পরীক্ষাটা করাবেন। পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে দুই তিন লাগতে পারে।

হিস্টোপ্যাথলজির রিপোর্ট পাওয়া গেল তিন দিন পর। নুরুল আমীন হোস্টেলেই থাকে। সন্ধার সময় প্রতিদিন একবার করে মর্জিনার কেবিনে এসে কিছুক্ষণ সময় দেয়।

কেবিনে আসার সময় হকার থেকে একটা কম দামি খবরের কাগজ নিয়ে এল। উদ্দেশ্য পেপার পড়া না। মর্জিনার কেবিনে যখন সে চেয়ারে বসে থাকে তখন দেখা যায় মর্জিনা কেমন যেন নুরুল আমীনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাতে সে কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করে।

তাই যখন অস্বস্তি লাগে তখন পেপার পড়ার ছলে পেপার দিয়ে মুখ ঢাকা যাবে। আবার মর্জিনাকে দেখতে ইচ্ছা হলে পেপারের কিনারা দিয়ে দেখা যাবে। মর্জিনার কেবিনে এসে সে বায়োপ্সি রিপোর্ট দেখে বলে

: রিপোর্ট ভাল। ক্যান্সার নাই। টিউমারের নাম ‘বিনাইন সিস্টিক টেরাটোমা’। আল্লাহ্‌র রহমতে আর কোন সমস্যা নাই।

এই সময় ডা. ফরিদা কেবিনে আসলেন। রিপোর্ট দেখে বুঝিয়ে বললেন,

: আর কোন সমস্যা হবে না, ক্যান্সার নেই।

: সাত দিনের পর ছুটি দিয়ে দেব। বাড়িতে গিয়ে মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে। লোকের কথায় কান দেবে না।

: আমার মেয়ে পড়ালেখায় ভালো। কোন হেলে মেলে নাই। পড়ায়ে আপনার মত ডাক্তার বানাব।

: আমিও গ্রামের মেয়ে। ছোটবেলায়ই আমার বাবা মারা যান। মা অনেক কষ্ট করে সংসার চালিয়ে আমাকে পড়িয়েছিলেন। আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় নিজের চেষ্টায় ডাক্তার হয়ে রোগীর সেবা করতে পারছি।

: দোয়া করবেন আমার মেয়ে যেন আপনার মত ডাক্তার হয়। মেয়েকে ডাক্তার দেখে বিয়ে দেব।

মর্জিনা নুরুল আমীনের চোখের দিকে তাকায়। নুরুল আমীনের লজ্জা লাগে। পেপার দিয়ে চোখ আড়াল করল। চোখ পড়ল পেপারের একটা হেডিং “অবৈধভাবে অন্তঃসত্ত্বা অষ্টম শ্রেণীর মর্জিনার আত্মহত্যার চেষ্টা।”

মর্জিনার মা ডা. ফরিদাকে জিজ্ঞেস করলেন

: আপা, একটা জিনিস আমার কাছে খটকা লাগছে। টিউমারের ভেতর চুল, দাঁত কেমনে আসলো?

: শরীরের যে কোন একটা কোষ পরিবর্তিত হয়ে ক্যান্সার কোষ হয়। এই ক্যান্সার কোষ সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়ে টিউমারের আকার ধারণ করে। কোষের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পরিপক্কতাও আসতে পারে। যে কোষ থেকে টিউমার হয় তখন সেই কোষের মতই টিউমার কোষ হয়।

মেয়েদের ওভারিতে এক প্রকার কোষ থাকে যাকে আমরা জার্ম সেল বলি। এই জার্ম সেল থেকে তৈরি হয় ডিম্ব। ডিম্বের ভিতর পুরুষের শুক্রাণু প্রবেশ করে যে কোষ তৈরি হয় সেই কোষ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে পরিপক্ক হয়ে পূর্ণাঙ্গ শিশু তৈরি হয়। ডিম্ব নিশিক্ত হয়ে যেমন মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি হয় সেই রকম জার্ম সেল নিষিক্ত না হয়ে টিউমার সেলে রূপান্তরিত হয়ে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি হতে থাকে।

টেরাটোমা নামক টিউমারে আমরা এইগুলি দেখতে পাই, যেমন চুল, দাঁত, চোখ, চামড়া, নখ, হাড় ইত্যাদি।

মর্জিনার টিউমারে যে আঠালো পদার্থ ছিল ওগুলি সিবাসিয়াস মেটেরিয়াল মানে ঘাম। ভেতরে চামড়া ছিল। সেই চামড়ায় চুল গজিয়ে এত বড় হয়েছিল। চামড়ার ঘামের গ্রন্থি থেকে ঘাম উৎপন্ন হয়ে টিউমার ভরে গিয়েছিল। এখন বুঝছেন?

: কিছু কিছু বুঝলাম। এটাও বুঝলাম, এতদিন যেসব মেয়েরা অন্তঃসত্ত্বার অপবাদ পেয়ে আত্মহত্যা করেছে তারা সবাই অন্তঃসত্ত্বা। আমার মেয়েটা যদি মরে যেত সবাই খারাপ জানত।

: আপনাদের নুরুল আমীন বুঝেছে। এই নুরুল আমীন!, তুমি ভাল করে বুঝিয়ে দিও।

: আচ্ছা, এই টিউমার হইল কেন?

: টিউমার হয় কেন তার সঠিক কারণ এখনো সব জানা যায়নি। তবে পরিবেশ দুষণ ও খাদ্যে ভেজাল তার অন্যতম কারণ।

ভবিষ্যতে আরো অনেক গবেষণা করে হয়ত সঠিক কারণ জানা যাবে। আমাদের গবেষণার বয়স তো শেষ হয়েই গেল। নুরুল আমীন ও মর্জিনারা ডাক্তার হয়ে হয়ত এর সঠিক কারণ উদঘাটন করবে। আমরা আশা করতে পারি।

নুরুল আমীন মর্জিনার দিকে তাকালো। মর্জিনাও নুরুল আমীনের দিকে তাকালে নুরুল আমীন আবার পেপার দিয়ে মুখ আড়াল করল। চোখে পড়ল আরেকটা নিউজ “রুপা হত্যার বিচারের দাবিতে আগামীকাল সারা দেশে স্কুল কলেজের সামনের রাস্তায় মানববন্ধন কর্মসূচি। ”

ডা. ফরিদা ওদের দোয়া করে বিদায় নিলেন। কিছুক্ষণ পর নুরুল আমীনও বিদায় নিল। বলল

: চাচী, আসি। দোয়া করবেন। আগামীকাল ওভারিয়ান টিউমার চ্যাপ্টারের ওপর আইটেম পরীক্ষা আছে।

: যাও বাবা। ভাল করে শিখে ভাল ডাক্তার হও।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল নুরুল আমীন। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন মর্জিনার মা। কিছুক্ষণ দেখা গেল নুরুল আমীনকে। রাস্তা পাড় হল। তারপর মিলিয়ে গেল হোস্টেল ক্যাম্পাসের দিকে। তিনি দীর্ঘশ্বাস নিলেন।

মর্জিনার মা ভাবলেন, ‘ওদের বয়সটা যদি আরেকটু কাছাকাছি হতো!

কনটেন্ট ক্রেডিট: মেডিভয়েস

এ জাতীয় আরো সংবাদ
© All rights reserved © 2023 Mohajog