1. sardardhaka@yahoo.com : adminmoha :
শুক্রবার, ২৪ মার্চ ২০২৩, ০২:১০ পূর্বাহ্ন

রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় নিয়ে যত বিভ্রান্তি

মহাযুগ নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০২০
  • ১১৮৩ বার

মো. মহানুর ইসলাম

বেশ কয়েক দিন ধরেই সামাজিক মাধ্যমে এবং গণ মাধ্যমে ‘টক অব দ্য মোমেন্ট’ ছিল মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার আবুবকর মামলার রায়। কিন্তু বিষয়টির ডি জ্যুরি ও ডি ফ্যাক্টো’র মধ্যে যে আসমান-জমিন ব্যবধান সেটি অধিকাংশ মানুষই বুঝতে ব্যর্থ! রায়টি অনেকটা গাম্বিয়ার পক্ষে এমনকি মিয়ানমারের বিপক্ষেই গেছে। যথারীতি মিয়ানমার রায়টি অস্বীকারও করেছে! কিন্তু কোটি টাকার প্রশ্ন হচ্ছে এই রায়ে কি এমন গুরুত্ববহন করে? আর এটি আদৌও কি মিয়ানমারকে গণহত্যা বন্ধ করতে বা রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ করতে বাধ্য করবে?

১৯৪৮ সালে অং সান সুচি’র বাবা জেনারেল অং সান এর নেতৃত্বে মিয়ানমার স্বাধীন হয়। জানলে অত্যন্ত আশ্চর্য হবেন যে, বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে এই মিয়ানমারের কিছু নেতার ছুরিকাঘাতেই ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বেই অং সান মারা যান। অং সান এর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের চড়াই উৎরাই দেখলেও আপনার মনে হবে ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি প্রথমে ব্রিটিশদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে জাপানের পক্ষে যোগ দেন। আবার জাপানের সঙ্গ ত্যাগ করে ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বন করেন। আরও অভিযোগ যে তিনি নিজের দেশের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন বলে তাকে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মিয়ানমারের উ থান্ট ছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মোটা দাগে ৩০ লক্ষ মানুষ নিহত হন, ২ লক্ষ ধর্ষিত হন। বাড়ি-ঘর, মিল-ফ্যাক্টরি-ইন্ডাস্ট্রি, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ধ্বংস হয়। কিন্তু এত কিছুর পরেও মিয়ানমারের জাতিসংঘের মহাসচিব ৭১’র এর গণহত্যাকে জেনোসাইড হিসেবে ঘোষণা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এমনকি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যদি তারা সমস্ত বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের যোগফল দাঁড় করানো যায়, তবে উপসংহারে বলা যাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষের লোক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষের লোক। উপরন্তু যখন বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য আবেদন করেন, তখন চীনের ভেটোর অজুহাতে বাংলাদেশের আবেদন বাতিল করা হয়।

আন্তর্জাতিক আদালত রায় দিল; কিন্তু এই রায়ে কি লাভ হবে? আমাদের মনে রাখতে হবে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় দেওয়ার ক্ষমতা আছে কিন্তু বলবত করার জন্য শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা নাই। মিয়ানমারের সকল অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য মানুষ সদা-সর্বদা অং সান সূচি’কে ধুয়ে দিচ্ছে! কিন্ত একবারও বুঝতে চেষ্টা করছে না আসলে সূচি মিয়ানমারের কি বা কে! ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, পুতিন যেমন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, সি জিন পিং যেমন চীনের চেয়ারম্যান কিন্তু সুচি তেমন ভাবে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট নন; বরং স্টেট কাউন্সিলর মাত্র। আর সেনা নিয়ন্ত্রিত মিয়ানমারে সুচির ক্ষমতা ঠিক ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথের চেয়ে খুব বেশি নয়।

মিয়ানমারের বেয়াদবির মাত্রা ও তালিকাও অনেক দীর্ঘ। ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফেলিয়ান অর্ডারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে তাদের দেশের নাগরিকদের ১৯৪৮ সাল থেকেই পুশ ইন-পুশ ব্যাক নাটকের মাধ্যমে বারবার বাংলাদেশে ঠেলে পাঠাচ্ছে। কিন্তু একবারও বাংলাদেশের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। এই দেশটি ১৯৪৮ সালের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণা বারবার লঙ্ঘন করেছে। ১৯৪৯ সালে গৃহীত গণহত্যা কনভেনশন ভঙ্গ করে প্রায় ৭০ বছর ধরে গণহত্যা চালাচ্ছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন ভঙ্গ করে বারবার বেসামরিক মানুষদের ওপর ভয়াবহ নির্মমতা দেখিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭৯ সালের সিডো সনদ লঙ্ঘন করে গ্যাং রেপসহ ভয়াবহ নারী নির্যাতন করেছে। ১৯৮৭ সালের শিশু অধিকার সনদের ৫৪টি ধারার মধ্যে অধিকাংশই ভঙ্গ করেছে। কফি আনান কমিশনের রির্পোটসহ আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু সংস্থাসহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা মিয়ানমারের গণহত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ হাজির করেছে। কিন্তু বাস্তবিকভাবে এর কোন সমাধান আসেনি। বর্তমান জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতিরেজও শান্তিরক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে মিয়ানমারে আর ২-পি বা প্রতিরক্ষার জন্য হস্তক্ষেপ ক্ষমতার মাধ্যমে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর হস্তক্ষেপ বিষয়ে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুই হয়নি।

আসলে বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রটাই এমন। ওয়াল স্ট্রিট কিংবা ডাইনিং স্ট্রিট অথবা রেড স্কয়ারে যদি একজন ব্যক্তি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন; তবে বিশ্বের বাঘা বাঘা মিডিয়া কমপক্ষে সপ্তাহ জুড়ে সেটিকে হেড লাইন কাভারেজ দেন! কিন্তু আফ্রিকার রুয়ান্ডা-বুরুন্ডির মত রাষ্ট্রে কয়েক লক্ষ মানুষ গণহত্যায় নিহত হলেও বিশ্ব মিডিয়ার বটম লাইনে সেই কাভারেজ আসে। জাতিসংঘ নিজেই লক ইন ইফেক্ট বা ভেটো নামক ফাঁদে আঁটকে আছে। জাতিসংঘের কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হবে বা হবে না তার জন্য আইন বড় বিষয় না; বড় বিষয় পরাশক্তিগুলোর বিশেষ করে ভেটো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর ইচ্ছা। চীন প্রতিটি মুহূর্তে মিয়ানমারের সাথে অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক-ভূকৌশলগত সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করছে। মোদীর ভারত শুধু প্রচ্ছন্ন সমর্থন নয়; পাশে থাকার কথাও বলে। রাশিয়া এই অঞ্চলে চীনের পাশে থাকবে বা থাকছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। যে রোহিঙ্গাদের মুসলমান বলে বিশ্ব মুসলিম সমবেদনা জানাচ্ছে সেই মুসলিমদের সংগঠন ওআইসি ও মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ রাষ্ট্রগুলোর তেমন একটি মাথা ব্যথা নাই বললেই চলে!

সেখানে ক্ষুদ্র আফ্রিকার দরিদ্র রাষ্ট্র গাম্বিয়া ও তার কৌসুলি আবুবকরের ঐকাত্বিক ইচ্ছা শুধু আন্তরিক প্রশংসার দাবি রাখতে পারে। আর পারে সমস্যা সমাধানের ছোট্ট একটি পথ সৃষ্টি করার অভিপ্রায়। ইতিহাস বলে হয়ত এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। কারণ আইনকে তোয়াক্কা না করার পেছনে অনেক আন্তর্জাতিক শক্তিই মিয়ানমারের পেছনে আছে।

কলামিস্ট: আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী

 

এ জাতীয় আরো সংবাদ
© All rights reserved © 2020 Mohajog