অরাজনৈতিক দাবি করা হেফাজতে ইসলামের উগ্রপন্থীদের নেতৃত্ব দিতেন সংগঠনটির সদ্য বিলুপ্ত কমিটির শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক শায়খ মুফতি হারুন ইজহার। সংগঠনে তাকে সবাই ‘মানহাজি’দের দলনেতা হিসেবেই চিনতেন। বক্তব্য-বিবৃতিতে জিহাদের ডাক দেওয়া হারুন ইজহারকে এর আগেও গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। জামিনে বেড়িয়ে আগের মতোই উগ্রপন্থা মতবাদ ছড়িয়ে কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিলেন তিনি। হেফাজতকে তিনিই উগ্রবাদের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তার সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ ও জেএমবির নেতাকর্মীদের যোগাযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) ভোরে চট্টগ্রামের লালখান বাজারের জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা থেকে এক সহযোগীসহ হারুন ইজহারকে গ্রেফতার করে এলিট ফোর্স র্যাব। পরে এদিন বিকালে তাকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। হাটহাজারী থানা পুলিশ হারুন ইজহারকে তিনটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে ২১ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছে। আদালত রিমান্ড শুনানির জন্য পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এলিট ফোর্স র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘সাম্প্রতিক মোদিবিরোধী আন্দোলনের নামে হেফাজত হাটহাজারীতে যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, তার মদদদাতা ছিলেন হারুন ইজহার। তার বিরুদ্ধে আগে থেকেই উগ্রপন্থা ছড়ানো এবং জঙ্গি কার্যক্রমে জড়ানোর অভিযোগে মামলাও রয়েছে। গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।’
গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, হেফাজতে ইসলামে ‘মানহাজি’ নামে বড় একটি গ্রুপ রয়েছে। এরাই বর্তমানে হেফাজতকে নানারকম আগ্রাসী কর্মসূচি দিতে বাধ্য করতো। হেফাজতে এই গ্রুপের প্রভাব অনেক বেশি। এই গ্রুপটির নেতৃত্বে ছিলেন হারুন ইজহার। এছাড়া তার নেতৃত্বাধীন গ্রুপটি ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ এর সময় এসে গেছে বলে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা করে বেড়াতো। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে কোনোভাবে একটি বিশৃঙ্খলা তৈরি করে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা।
ধর্মীয় রাজনীতি ও জঙ্গিবাদের পরিভাষায় যারা সরাসরি জিহাদের ডাক দিয়ে কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাদেরকে মানহাজি বলে। আর হিন্দুস্থান বা ভারতীয় উপমহাদেশে একটি যুদ্ধে মুসলিমদের জয়লাভ ও যোদ্ধাদের শামে (সিরিয়া) ফিরে যাওয়ার বর্ণনা সংবলিত একটি হাদিস উল্লেখ করে তাকে গাজওয়াতুল হিন্দ বলা হয়।
র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০০৯ সালে হারুন ইজহারের পরিচালনাধীন লালখান বাজারে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জামিয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়া মাদরাসা ঘিরে আন্তঃদেশীয় জঙ্গিরা একটি ঘঁটি তৈরি করেছিল। ওই বছরের শেষ দিকে তারা ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস ও ভারতীয় হাইকমিশনারের কার্যালয়ে হামলার ছক কষেছিল। এই পরিকল্পনার সঙ্গে ছিল ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন লস্কর ই-তৈয়্যবা। হারুন ইজহার পুরো এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেসময় ওই মাদ্রাসায় অভিযান চালিয়ে হারুন ইজহার এবং লস্কর-ই-তৈয়্যবার কয়েকজন সদস্য ও ভারতীয় নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, ২০১৩ সালেও একবার হারুন ইজহারকে গ্রেফতার করেছিলেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ওই বছরের ১০ জুলাই হারুন ইজহারের জামিয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়া মাদরাসায় গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটলে তিন জন নিহত হন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে চারটি তাজা গ্রেনেড, বিপুল পরিমাণ গ্রেনেড তৈরির সরাঞ্জাম উদ্ধার করে। ওই ঘটনাতেও দেহরক্ষী জুনায়েদসহ হারুন ইজহারকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তবে কয়েক বছর কারাগারে থাকার পর আবারও জেল থেকে বের হয়ে আসেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মাস কয়েক আগে আতিকুল্লাহ নামে হরকাতুল জিহাদের এক শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করেছিল ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসি। আতিকুল্লাহ জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ কর্মকর্তাদের সে সময় জানিয়েছিল, হরকাতুল জিহাদ ও আফগান ফেরত মুজাহিদদের অনেকেই বর্তমানে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানান, হরকাতুল জিহাদ ও আফগান ফেরত মুজাহিদদের নতুন করে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে যোগসূত্র ঘটিয়ে দেওয়ার কাজটি মূলত হারুন ইজহার করতেন। তাকে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি এসব বিষয়ে আরও বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য উদ্ঘাটন করা হবে।