ঢাকা : মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দ্বারা হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে থেকে পালিয়ে আসা কয়েক লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে বাংলাদেশে রেখে দেওয়ার বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব এরইমধ্যে নাকচ করে দিয়েছে সরকার। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের ওই প্রস্তাব বেআইনি, অনৈতিক এবং অগ্রহণযোগ্য। এটি আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করছেন তারা।
তাদের মতে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না করে জিইয়ে রাখলে দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের চেয়েও সমস্যা বেশি ঘনীভূত হবে। এতে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তিশৃঙ্খলা যথেষ্ট হুমকির মুখে পড়বে।
আর বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার অর্থই হলো রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়া। কারণ, বিষয়টি যেহেতু নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত আইসিজেতে বিচারাধীন, সেদিক থেকেও এই প্রস্তাবকে বেআইনি বলে মত দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশি নাগরিকরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে যেসব সুযোগসুবিধা পায়, মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদেরও তার সব সুবিধা দেওয়ার আবদার জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
বিষয়টি নিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ বলেন, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের এই প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই প্রস্তাবের আন্তর্জাতিক ভিত্তি নেই এবং তারা ভূরাজনৈতিক কারণে প্ররোচিত হয়েই প্রস্তাবটি দিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিধান অনুযায়ীও তারা এ ধরনের প্রস্তাব দিতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রস্তাবটি বাংলাদেশের কোনোভাবেই মেনে নেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের হলেও রিফিউজি কনভেনশন অনুযায়ী এটি আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং এক্ষেত্রে সবার দায় আছে। সেই দায়কে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া প্রহসনমূলক। আন্তর্জাতিকচক্র ক্রমেই সক্রিয় হয়ে উঠছে। আমাদের এই অঞ্চলের শান্তি বা স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য আমাদের এখানে যেসব সমস্যা রয়েছে সেক্ষেত্রেও তারা রোহিঙ্গা ইস্যুটি ব্যবহার করতে চায়। বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার এ ধরনের উদ্ভট প্রস্তাব দেওয়ার অর্থ হচ্ছে-এতে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ হবে না।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটিস্ স্টাডিসের প্রেসিডেন্ট অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মুনিরুজ্জামান বলেন, বিশ্বব্যাংক সমস্যাটা বাংলাদেশের ঘাড়ে দিয়ে দিতে চাচ্ছে। একবার কিছু থোক বরাদ্দ দিয়ে তাদের দায়বদ্ধতা থেকে সরে যেতে চাচ্ছে, যেটা গ্রহণযোগ্য না। অথচ জাতিসংঘ থেকে শুরু করে সবাই এটা স্বীকৃতি দিয়েছে যে, রোহিঙ্গাদের ওপর বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণহত্যা চালানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবকে যদি আমরা মেনে নেই তাহলে গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়া হবে। যেটা কোনোভাবেই হতে পারেনা। এখানে শুধু ১০-১২ লাখ রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করাই মুখ্য না, আন্তর্জাতিক আইনের বিষয়টিও রয়েছে। কারণ, বিষয়টি বর্তমানে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারাধীন। সেই আদালত থেকে যেহেতু এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি, এটা নিয়ে কি করে বিশ্বব্যাংক এ ধরনের প্রস্তাব দেয়?’
বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবে ঢাকা রাজি নয়।আমাদের অগ্রাধিকার ইস্যু হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন, রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে।’
তিনি গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বিশ্ব ব্যাংক একটা রিপোর্ট তৈরি করেছে, এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, ১৬টা দেশের জন্য। যে সমস্ত দেশে রিফিউজি আছে সেখানে তাদের হোস্ট কান্ট্রিতে ইন্টিগ্রেট করার বিষয়ে। যেহেতু রোহিঙ্গারা রিফিউজি না, আমরা এটা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছি। এই রিপোর্টের সঙ্গে আমাদের চিন্তাভাবনার মিল নেই। আমরা মনে করি, রোহিঙ্গাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য একমাত্র পথ হচ্ছে নিজের দেশে ফিরে যাওয়া। আমরা তাদের ক্ষণিকের জন্য আশ্রয় দিয়েছি।’