এই পর্যন্ত যে ছয়জন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, তার মধ্যে এই প্রথম কাশিমপুরে কারও ফাঁসি হল। আগের পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ডই কার্যকর হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, যা কেরানীগঞ্জে সম্প্রতি সরে গেছে।
ফাঁসিতে ঝোলানোর দুই ঘণ্টা পর রাত সাড়ে ১২টায় র্যাব-পুলিশের পাহারায় অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা ইউনিয়নের চালা গ্রামে।
চালা গ্রামে তার আগেই পৌঁছে যান মীর কাসেমের স্বজনরা, যারা বিকালেই কাশিমপুরে কারাগারে তার সঙ্গে শেষ দেখা করে এসেছিলেন।
মীর কাসেমের বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে হলেও তার পৈত্রিক এলাকা মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলায়। ১৯৫২ সালে তার জন্মও সেখানে।
পৈত্রিক বাড়ি সূতালড়ি ইউনিয়নের মুন্সীডাঙ্গী গ্রামে হলেও নদী ভাঙনে ভিটে হারিয়ে যাওয়ার পর চালা ইউনিয়নের চালা গ্রামে জমি কিনেছিলেন কাসেম।
রাত পৌনে ৩টার দিকে লাশ পৌঁছানোর পর জানাজা শেষে লাশ একবার স্বজনদের দেখানো হয়। এরপর রাত সাড়ে ৩টার দিকে দাফন করা হয় মীর কাসেমকে।
দাফনের বিষয়ে আগে থেকে জানানো না হলেও মৃত্যুদণ্ডের পর কাশিমপুরের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক প্রশান্ত কুমার বণিক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মীর কাসেমের লাশ মানিকগঞ্জে পাঠানো হবে।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুণ-অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, “লাশ যেখানে যাবে, সে পর্যন্ত আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে।”
চালা গ্রাম থেকে চার কিলোমিটার দূরে ঘিওর উপজেলার কলতাবাজারে পুলিশ রাতেই অবস্থান নিয়ে গ্রামের বাসিন্দা ছাড়া অন্য কারও ঢোকা আটকে দেয়।
সেখানে থাকা ঘিওর থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন, রাত ১০টা ৫০ মিনিটে চারটি গাড়িতে করে মীর কাসেমের স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই পুত্রবধূসহ ৪০ জনের মতো স্বজন চালা গ্রামে যান।
মীর কাসেম চালা ইউনিয়নে কেনা জমিতে বাড়ি না করলেও একটি মসজিদ তৈরি করেছিলেন। বিএনপি-জামায়াত জোটের হয়ে তিনি ওই এলাকা থেকে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীও হতে চেয়েছিলেন।
মানিকগঞ্জ শহর থেকে হরিরামপুরের চালা গ্রামের দূরত্ব ২৫ কিলোমিটারের মতো। শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে ঘিওর উপজেলার কলতাবাজারের উপর দিয়ে যেতে হয় চালা গ্রামে।
মীর কাসেমের স্বজনরা কলতাবাজার পৌঁছেন পাঁচটি গাড়ি নিয়ে। ওই সময় সেখানে পুলিশ তাদের থামিয়ে ১৫ মিনিটের মতো কথা বলে। পরে চারটি গাড়ি যেতে দেওয়া হয়।
মীর কাসেমকে মানিকগঞ্জে দাফন করতে তার স্ত্রীর পরিকল্পনার কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে এলে সন্ধ্যার পর জেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল করে মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। তাদের সমাবেশ থেকে এই যুদ্ধাপরাধীর লাশ মানিকগঞ্জে না নেওয়ার দাবি জানানো হয়।
মুক্তিযোদ্ধা তোবারক হোসেন লুডু বলেন, “মীর কাসেম আলীর জন্ম মানিকগঞ্জে হওয়ায় আমরা লজ্জিত। শুনতে পাচ্ছি তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর হরিরামপুরের চালা গ্রামে মরদেহ দাফন করা হতে পারে।
“একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি জানাচ্ছি, এই কুলাঙ্গারের মরদেহ যেন মানিকগঞ্জে দাফন না হয়।”
রেলওয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর ছেলে মীর কাসেম ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর জামায়াতে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি নানা ব্যবসার মাধ্যমে দলটির ‘আর্থিক মেরুদণ্ডে’ পরিণত হন।
তিনি ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও ছিলেন তিনি।
রাবেতা আল ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মীর কাসেম দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানও ছিলেন। কেয়ারি গ্রুপের কর্ণধার হিসেবেও তার নাম আসে।
তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত সোমবার সারাদেশে আধাবেলা হরতাল ডেকেছে। তারা দাবি করে করেছে, অন্যায় বিচারের সাজা হয়েছে তাদের নেতার।
অন্য দিকে যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার দায়ে মীর কাসেমকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে, সেই জসিম উদ্দিনের বোন হাসিনা খাতুন বলেছেন, ৪৫ বছর ধরে ‘বুকের ভেতর চেপে বসা পাথর’ যেন নেমে গেল।
একাত্তরে চট্টগ্রামে এই বদর কমান্ডার পরিচালিত ‘মৃত্যুঘর’ ডালিম হোটেলের নির্যাতিতরা মীর কাসেমের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের দাবিও তুলেছেন।