প্রতিবেদক : নির্বাচনে টাকার প্রভাব খাটানো ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকা, নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলা, নির্বাচিত হলে সিটি করপোরেশনকে দুর্নীতিমুক্ত, কার্যকর ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের প্রার্থীরা।
শনিবার নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) উদ্যোগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সব মেয়র পদপ্রার্থীকে নিয়ে আয়োজিত ‘জনগণের মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানে তাঁরা এসব অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এ সময় প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে নারায়ণগঞ্জকে একটি বাসযোগ্য নগরীতে পরিণত করার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সব প্রার্থীই উপস্থিত ছিলেন। বেলা সাড়ে তিনটায় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠানটি। সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। সুজন প্রণীত ১৩ দফা লিখিত অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেন মেয়র পদপ্রার্থীরা। এ সময় তাঁরা দাঁড়িয়ে একে অপরের হাত ধরে অঙ্গীকারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
এ ছাড়া উপস্থিত ভোটাররাও ভোট দেওয়াকে পবিত্র দায়িত্ব মনে করে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। বদিউল আলম মজুমদার ভোটারদের শপথনামা পাঠ করান।
প্রার্থীদের বক্তব্য শুরু হওয়ার আগে সুজনের নির্বাহী সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘উন্নয়ন, সুশাসন, গণতন্ত্র এই সমস্ত বিষয় যাতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, সেটাই চায় সুজন। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি বন্দরনগরী ও বিশ্ববিখ্যাত।’ যিনি নির্বাচিত হবেন তিনি যে দলেরই হোন না কেন, নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সব দলের হবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বড় প্রতিশ্রুতি দিতে চান না আইভী, মাস্টারপ্ল্যান করবেন সাখাওয়াত
সদ্য সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ‘বড় বড়’ প্রতিশ্রুতি দিতে পারবেন না উল্লেখ করে বলেন, স্থানীয় সরকার চাইলেই সবকিছু করতে পারে না। এখানে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ আছে যাদের নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হয়। তিনি বলেন, মেয়র হানিফ ‘সিটি গভর্ন্যান্স’-এর কথা বলেছিলেন। একমাত্র এটা হলে অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
আইভী বলেন, জরাজীর্ণ অবস্থায় তিনি সিটি করপোরেশনের কাজ শুরু করেছিলেন। যেসব কাজ শুরু করেছিলেন তার অনেকগুলোরই ৭০ ভাগ শেষ হয়েছে। বাকি ৩০ ভাগও তিনি নির্বাচিত হয়েই শেষ করতে চান।
বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত বলেন, মেয়র হলে সব পেশার মানুষকে নিয়ে সর্বপ্রথম নারায়ণগঞ্জ শহরের জন্য তিনি একটি মাস্টারপ্ল্যান করবেন। পরবর্তী সময় সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই কাজ করবেন তিনি। এ ছাড়া ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে একটি সবুজ নগরী গড়ার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন এই প্রার্থী।
নারায়ণগঞ্জকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার প্রতিশ্রুতি প্রার্থীদের
অনুষ্ঠানে প্রত্যেক মেয়র প্রার্থীকে তিন মিনিট করে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। এ সময় তাঁরা উপস্থিত ভোটারদের কাছে নিজেদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেন। সদ্য সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ছাড়া অন্য অধিকাংশ প্রার্থীই নারায়ণগঞ্জকে অপরিচ্ছন্ন নগরী এবং মাদক ও সন্ত্রাসের আখড়া হিসেবে উপস্থাপন করেন। এসব সমস্যা সমাধানে তাঁরা নিজেদের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেন।
ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী মুফতি এজাহারুল হক বলেন, মেয়র নির্বাচিত হলে তিনি যানজটমুক্ত নগর উপহার দেবেন। শহরের অলিতে গলিতে গড়ে ওঠা মাদকের আখড়া উচ্ছেদ করে সন্ত্রাসীদের উৎপাত ও অস্ত্রের ঝনঝনানিমুক্ত নগর গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাওলানা মো. মাছুম বিল্লাহ বলেন, হকারে নারায়ণগঞ্জ শহরে ছেয়ে গেছে। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে উচ্ছেদ করবেন তিনি।
বাংলাদেশে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী মাহবুবুর রহমান ইসমাঈল বলেন, যানজট, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পরিবেশদূষণ ও জলাবদ্ধতা নগরে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করেছে যে একে কোনোভাবেই উন্নত সিটি করপোরেশন বলা যাচ্ছে না। শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষিত, উল্লেখ করে তিনি বলেন, নাকে রুমাল দিয়ে নদীর পাশ দিয়ে যেতে হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তিনি কাজ করবেন।
বাংলাদেশে কল্যাণ পার্টির প্রার্থী মো. রাশেদ ফেরদৌস মাদকমুক্ত যুব ও তরুণ সমাজ গঠনের জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন।
দলবাজি করবেন না আইভী, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রাখবেন সাখাওয়াত
প্রার্থীদের তিন মিনিট করে বক্তব্য শেষ হওয়ার পর প্রত্যেক প্রার্থীকে তিনটি করে প্রশ্নের মুখোমুখি করা হয়। এ সময় এক তরুণ ভোটার আইভীর কাছে দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত হলে কাজে দলীয় প্রভাব কতটা থাকবে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বছর দলীয় মনোনয়নের বিষয় ছিল না। কিন্তু তারপরও তিনি আওয়ামী লীগের একজন হিসেবেই নির্বাচন করেছিলেন। ওই সময় তাঁর সাংগঠনিক পরিচয়ও ছিল। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি কোনো ধরনের দলবাজি করেননি। আল্লাহকে হাজির নাজির রেখে তিনি বলেন, একইভাবে এবার ‘সিস্টেমের’ কারণে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে নির্বাচিত হলেও তিনি সবার মেয়র হবেন।
নির্বাচিত হলে সাবেক মেয়র যে উন্নয় করেছেন তার ধারাবাহিকতা রক্ষা হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সাখাওয়াত হোসেন নগর ও নাগরিকের স্বার্থে দলমত-নির্বিশেষে সবার মতামত নিয়ে কাজ করবেন বলে জানান। তারই ধারাবাহিকতায় উন্নয়নকাজও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তিনি।
প্রশ্নোত্তর পর্বে আইভী ও সাখাওয়াত সমর্থকদের বেশ কয়েকবার বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। এ সময় অনুষ্ঠানস্থলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি আব্দুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে সুজন মহানগর কমিটির সভাপতি আহসানুল চৌধুরী বাবুল, জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ধীমান সাহা জুয়েল, সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।