1. sardardhaka@yahoo.com : adminmoha : Sardar Dhaka
  2. nafij.moon@gmail.com : Nafij Moon : Nafij Moon
  3. rafiqul@mohajog.com : Rafiqul Islam : Rafiqul Islam
  4. sardar@mohajog.com : Shahjahan Sardar : Shahjahan Sardar
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ১১:৪৮ পূর্বাহ্ন

কানের কাছে গুলি

মহাযুগ নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬
  • ২৮৯ বার

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : দেশের মানুষজন সবাই ঘটনাটি জানে কী না আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু আমাদের কানের খুব কাছে দিয়ে একটা গুলি গেছে। এই মাসের গোড়ার দিকে হঠাৎ করে আমরা জানতে পারলাম শিক্ষা আইনের যে চূড়ান্ত খসড়াটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য পাঠানো হচ্ছে সেখানে কোচিং টিউশনি গাইড বই সবগুলোকে জায়েজ করে দেয়া হয়েছে।
আমি যখন রিপোর্টটি পড়ছিলাম তখন আতংকে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল এবং আমার মনে হচ্ছিল এক্ষুণি আমি দেখতে পাব শুধু কোচিং টিউশনি এবং গাইড বই নয় প্রশ্ন ফাঁস এবং নকলকেও বৈধ করে দেয়া হয়েছে! কোচিং এবং টিউশনির নাম দেয়া হয়েছে “ছায়া শিক্ষা” এবং ছায়া শিক্ষার অর্থ হচ্ছে টাকা নিয়ে কোনো ব্যক্তি বা শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে কোনো স্থানে পাঠদান কার্যক্রম! আগে তবুও কোচিং বা টিউশনি বিষয়টিতে এক ধরনের চক্ষুলজ্জার বিষয় ছিল, ছায়া শিক্ষা নাম দিয়ে সেটার পিছনে সরকারি অনুমোদনের সিল মেরে দেয়ার পর সেটাতে ঠেকিয়ে রাখার আর কোনো উপায় থাকল না।
আমাদের দুঃখটা অনেক বেশি হয়েছিল কারণ শিক্ষা আইনের খসড়াতে আগে এগুলো শুধু যে বে আইনি ঘোষণা করা হয়েছিল তা নয়, সেগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাবও করা হয়েছিল। শুধু যে কোচিং সেন্টার এবং প্রাইভেট টিউশনিকে বৈধ করা হয়েছিল তা নয় সহায়ক বইয়ের বিষয়টি এমনভাবে লেখা হয়েছে যে এখন যেকোনো ধরনের বই প্রকাশের আইনি সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। গাইড বই ছাপিয়ে রমরমা ব্যবসায় একেবারে সুবর্ণ সুযোগ।
বলা বাহুল্য রিপোর্টটি দেখে আমার এবং আমার মতো সবার খুব মন খারাপ হয়েছিল। আমরা সবাই প্রতারিত বোধ করছিলাম। তার কারণ মাত্র কিছুদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বড় বড় কর্মকর্তাদের নিয়ে আমরা কক্সবাজারে পড়শোনা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছি, চমৎকার চমৎকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন দেখছি যারা আমাদের সাথে ছিলেন তারাই কোচিং টিউশনি গাইড বইকে জায়েজ করে দিয়েছে। কী ভয়ংকর কথা!
খুবই সঙ্গত কারণে দেশের শিক্ষাবিদেরা সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করলেন। তাদের প্রতিবাদে কাজ না হলে কীভাবে সবাইকে নিয়ে আন্দোলন শুরু করতে হবে সেটাও আমার মাথায় উঁকি দিয়ে গেল। মোট কথা আমরা খুব অশান্তিতে ছিলাম।
পত্রপত্রিকায় এখনো বিষয়টি আমার চোখে পড়েনি কিন্তু খবর নিয়ে জানতে পেরেছি শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোচিং টিউশনিকে বৈধতা দেয়ার উদ্যোগ দেয়া থেকে শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে এসেছে।
গাইড বই বিক্রেতারা ধর্মঘট করছে জেনে খুব আনন্দ পেলাম, যে সিদ্ধান্তটি নেয়া হচ্ছে সেটি নিশ্চয়ই অধিক সিদ্ধান্ত তা না হলে গাইড বইয়ের প্রকাশকেরা কেন ধর্মঘট করতে যাবে? দেশের লেখাপড়ার বিষয়ে গাইড বইয়ের প্রকাশক থেকে বড় শত্রু আর কে হতে পারে? তারা অসুখী থাকলেই আমরা সুখী।
আমি এখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছি, শিক্ষানীতির সাথে সাথে একটা শিক্ষা আইনের দরকার। আমরা সবাই জানি শুধু নীতি যথেষ্ট নয়, নীতিকে বাস্তবায়ন করার জন্য আইনের সাহায্য নিতে হয়। সেই আইনটিই যদি ভুল একটা আইন হয় তাহলে আমরা কোথায় আশ্রয় নিতে যাব?
কাজেই এই দেশের সব শিক্ষাবিদদের সাথে আমিও নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে আছি একটা চমৎকার আইনের জন্য। এখনো আমার বুক ধুক ধুক করছে, মনে হচ্ছে একটা ফাঁস কাটল, কানের খুব কাছে দিয়ে একটা গুলি চলে গেল। ভয় হয় আবার না নূতন একটা গুলি চলে আসে।
গত কয়েক বছরে আমাদের একটা বড় ক্ষতি হয়েছে। সেটা হচ্ছে লেখাপড়া বিষয়টা কী সেটা নিয়ে সবার ভেতরে একটা ভুল ধারণা জন্মে যাচ্ছে। কীভাবে কীভাবে জানি সবার ধারণা হয়েছে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া হচ্ছে ভালো লেখাপড়া। তাই পুরো লেখাপড়াটা হয়ে গেছে পরীক্ষাকেন্দ্রিক! কোনো কিছু শেখা নিয়ে ছেলেমেয়েদের আগ্রহ নেই, একটা প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দেয়া যাবে সেটা নিয়ে সবার আগ্রহ। লেখাপড়াটা হয়ে যাচ্ছে প্রশ্নের উত্তর শেখা।
একজন ছেলে বা মেয়ে যখন নূতন কিছু পড়ে নূতন কিছু শিখে তার মাঝে এক ধরনের আনন্দ থাকে। কিন্তু একজন ছেলে বা মেয়ে যখন একই বিষয় শিখে শুধু প্রশ্নের উত্তর হিসেবে তার মাঝে কোনো আনন্দ নেই। সবচেয়ে বড় কথা একজন ছেলে বা মেয়ে কোনো বিষয়ের অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে মুখস্থ করে রাখলেও সেটি কিন্তু কোনোভাবে গ্যারান্টি করে না যে সে তার বিষয়টা সঠিকভাবে জানে।
সে জন্যে আমরা দেখতে পাই জিপিএ ফাইভ(বা গোল্ডেন ফাইভ!) পেয়েও একজন ছেলে বা মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাশ মার্কটুকুও তুলতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা মোটেও খুব উচু শ্রেণীর পরীক্ষা নয়, এই পরীক্ষায় ভালো করার বিশেষ কোনো গুরুত্ব নেই, কিন্তু পাশ মার্কও তুলতে না পারা আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় লেখাপড়া নিয়ে আমাদের বড় ধরনের সমস্যা আছে।
আমাদের দেশে কেন কোচিং বন্ধ করতে হবে সেটি নিয়ে অনেক কিছু বলা যায়, এর বিপক্ষে সবচেয়ে বড় যে যুক্তিটি দেয়া যায় সেটা হচ্ছে এটা আমাদের দেশে একটা বড় ধরনের বৈষম্যের তৈরি করে। যার অনেক টাকা সে তার ছেলেমেয়েদের জন্যে অনেক প্রাইভেট টিউটর রাখতে পারবে, আর যার টাকা নেই সে তার ছেলেমেয়েদের জন্য কোনো প্রাইভেট টিউটর রাখতে পারবে না।
সেটি সত্যিকার অর্থে বড় কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয় এবং আমাদের মনে করা উচিৎ দরিদ্র বাবা মায়ের দরিদ্র সন্তানটিই সৌভাগ্যবান, তার টিউশনী কিংবা কোচিংয়ের পীড়ন সহ্য করতে হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটে না, কারণ আমরা সবাই জানি স্কুল কলেজের অনেক শিক্ষকের মাঝে এক ধরনের নৈতিক অধঃপতন হয়েছে। তারা আজকাল ক্লাশরুমে পড়ান না, তারা কোচিং কিংবা ব্যাচে পড়ান। যে ছেলে বা মেয়েটি তার শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে না তার শেখার সুযোগ থাকে না।
কাজেই এই দেশে এখন দরিদ্র ছেলেমেয়েদের স্কুলের ছাত্র হয়েও লেখাপড়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে। আমরা বিষয়টি জানি, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা পড়তে আসে, আমি তাদের খোঁজ নিয়ে দেখেছি তাদের সবাই এখন চিন্তাশীল বাবা মায়ের সন্তান। লেখাপড়াটাই এখন এই দেশের সব ছেলেমেয়ের জন্য নয়- এই দেশের বিত্তশালী মানুষের জন্য।
আমাদের এই কুৎসিত নিয়মটি ভাঙার কথা এটাকে শক্তিশালী করার কথা নয়। যদি আমরা কোচিং আর টিউশনিকে একেবারে আইনি বৈধতা দিয়ে দেই তাহলে বলা যায় আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দেশের গরীব বাবা মায়ের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের সকল স্বপ্নকে ধ্বংস করে দিচ্ছি। আমাদের একটু একটু করে এই কুৎসিত চক্রটিকে ভাঙার কথা এটাকে শক্তিশালী করার কথা নয়।
পৃথিবীর সবাই স্বীকার করে নিয়েছে লেখাপড়ার নিয়মের একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। কী পড়ছে, কীভাবে পড়ছেন সেটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নাই, পরীক্ষায় কতো পেয়েছে সেটা নিয়েও কারো কৌতুহল নেই, সবাই দেখতে চায়, সে কতটুকু শিখেছে!
সেটা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের ছেলেমেয়েদের কোচিং সেন্টার থেকে ক্লাশরুম ফিরিয়ে আনতে হবে। গাইড বই সরিয়ে তাদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দিতে হবে। এই জরুরি দুটো কাজে আমরা যদি দেশের আইনের সহযোগিতা না পাই, উল্টো যদি দেশের আইন কোচিং সেন্টার আর গাইড বইকেই বৈধতা দিয়ে দেয় তাহলে একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
শিক্ষা আইনের প্রাথমিক খসড়াটিতে কোচিং গাইড বই শুধু নিষিদ্ধ ছিলো না, এর জন্য শাস্তির কথা পর্যন্ত বলা হয়েছিলো, সেই আইনটি পরিবর্তন করে একেবারে আটঘাট বেঁধে তাদের পুরোপুরি বৈধতা দিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলো তার কারণটি বুঝতে কারো সায়েন্টিস্ট হতে হবে না।
আমরা সবাই জানি যারা এর বৈধতার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে তাদের টাকার বা ক্ষমতার অভাব নেই। এদের মাঝে কোচিং সেন্টারের মালিক, গাইড বইয়ের প্রকাশকের সাথে সাথে দেশের সবগুলো প্রথম সারির খবরের কাগজগুলো আছে তার কারণ তারা সবাই নিয়মিতভাবে সেখানে গাইড বই ছাপিয়ে যাচ্ছে। এরকম বিষয়ে জনমত তৈরি করার জন্য সংবাদপত্রের সাহায্য নেয়া হয়- কিন্তু যেখানে সংবাদপত্রগুলো নিজেরাই গাইড বই ছাপিয়ে যাচ্ছে সেখানে তারা কতোটুকু সাহায্য করবে?
আমরা সবাই এখন রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা করে আছি। আশা করে আছি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রিসভা আমাদের হতাশ করবে না, আমরা চমৎকার একটা শিক্ষা আইন পাব যেটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আমরা আমাদের শিক্ষা জগতের দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে যাবো। আশা করে আছি কানের কাছ দিয়ে যে গুলিটা গেছে সেটা আর অন্য কোনো দিক থেকে অন্যভাবে ফিরে আসবে না।

এ জাতীয় আরো সংবাদ
© All rights reserved © 2023 Mohajog