প্রতিবেদক : তিন দিনের সফরে বুধবার বিকালে ঢাকায় আসবেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। তাকে স্বাগত জানাবেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এটিই মাহমুদ আব্বাসের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর; গত বছর ফেব্রুয়ারিতে জর্ডান থেকে জাপান যাওয়ার পথে ঢাকায় কয়েক ঘণ্টা যাত্রাবিরতি করেছিলেন তিনি।
তার সফর উপলক্ষে ঢাকার বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন সড়ক দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানিয়ে বার্তা।
ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে বাংলাদেশ প্রথম থেকেই ফিলিস্তিনি সরকার ও জনগণের পাশে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভাতেও বাংলাদেশ স্বাধীন ফিলিস্তিনের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।
দেশটির মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতও এর আগে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সফর করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় মাহমুদ আব্বাসের এ সফরকে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করছেন ঢাকায় ফিলিস্তিনের মিশন প্রধান ইউসুফ এসওয়াই রামাদান। তিনি বলেন, “এ সফর বাংলাদেশের জন্য যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, ফিলিস্তিনের জন্য তারচেয়েও বেশি। আমরা এই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর; সম্পর্ক দৃঢ় করতে যা যা করা সম্ভব- সবই আমরা করতে চাই।”
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ১৯৬৭ সালের মানচিত্র অনুযায়ী পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থন দিয়ে আসছে। ঢাকা বরাবরই বলে আসছে, কোনো স্বার্থের ভিত্তিতে নয়, সংবিধানে বলা আদর্শের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামে বাংলাদেশের এই সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন বিষয়ক ২৫(গ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ‘সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের সমর্থন’ করবে।
ইউসুফ বলেন, বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ে আছে ফিলিস্তিন। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সফর দুই দেশের এই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেবে বলে তার বিশ্বাস। আমরা সেটা অনুভব করতে পারি। আমরা সত্যিই গর্বিত এমন মানুষের সমর্থন ও সম্পর্কের জন্য। আমরা এই সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে চাই, রক্ষা করতে চাই, লালন করতে চাই। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টের এই সফরের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব একটি ‘স্পষ্ট বার্তা’ পাবে বলেও মনে করেন মিশন প্রধান।
“বাংলাদেশ-ফিলিস্তিনের এমন সম্পর্ককে কেউ বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারবে না, এটা স্পষ্ট একটি বার্তা। আমরা দুই পক্ষই এ সম্পর্ক বজায় রাখতে উদগ্রীব।”
স্বার্থ নয়, আদর্শের ভিত্তিতে দাঁড়ানো এ বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
এই সফরে মাহমুদ আব্বাস বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করবেন।
বৈঠকে দুই দেশ দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী আগেই জানিয়েছেন।
দুই নেতার আলোচনায় কৃষি, জ্বালানি ও বিদ্যুতের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ তথ্য সহযোগিতার বিষয় থাকবে বলেও আভাস দিয়ে রেখেছেন মাহমুদ আলী।
গত বছরের ১১ ডিসেম্বর দুই দেশ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে একটি সহযোগিতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ঢাকায় পৌঁছে উঠবেন হোটেল লো মেরিডিয়ানে। সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী হোটেলে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন মাহমুদ আব্বাস। পরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরও ঘুরে দেখবেন।
বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনার কার্যালয়ে তার সঙ্গে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে। পরে মাহমুদ আব্বাস ফিরবেন হোটেলে। সেখানে তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের বৈঠক হবে। ফিলিস্তিনি নেতা তার সম্মানে বঙ্গভবনের নৈশভোজেও অংশ নেবেন।
ঢাকায় ফিলিস্তিনের মিশন প্রধান ইউসুফ জানান, মাহমুদ আব্বাসের এই সফরে দ্বিপাক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে দুই দেশের সরকারের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই স্মারকে সই করবেন।
এছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনি কূটনীতিকদের জন্য ভিসামুক্ত যাতায়াতের সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা আসতে পারে বলেও জানান তিনি।
ইউসুফ জানান, দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের স্মারক হিসেবে অন্তত ১০০ সামরিক ও বেসামরিক শিক্ষার্থী বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন মেয়াদের বৃত্তি নিয়ে পড়ালেখা করছে।
জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের ‘পূর্ণ সদস্যপদের’ দাবিতেও সমর্থন দিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
গত ডিসেম্বরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের বিরোধিতা করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক প্রস্তাবেও বাংলাদেশ সমর্থন দেয়। দীর্ঘ দিনের রীতি ভেঙে ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বন না করে ওই প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল যুক্তরাষ্ট্রও। সেজন্য দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসাও পেয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নেওয়ার আগেই বলেছিলেন, তিনি ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেবেন; যাকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য হুমকি মনে করছেন অনেকে।
ইউসুফ বলেন, ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত দূতাবাস জেরুজালেমে নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন বলে ফিলিস্তিন সরকার মনে করছে না।
“নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব প্রেসিডেন্ট এমনটা বলেন। কিন্তু উপদেষ্টা, প্রশাসন ও গোয়েন্দারা জানেন, ট্রাম্প যদি এ ধরনের কিছু ঘটান, তাহলে তিনি শান্তি প্রক্রিয়ার মাথায় গুলি ছুড়বেন। এ কারণে তারা ট্রাম্পকে তেমন কিছু করতে দেবেন না বলেই আমাদের বিশ্বাস।”
আর যদি সত্যিই তেমন কিছু ঘটে যায়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি বলে কিছু থাকবে না বলে মনে করেন ফিলিস্তিনের দূত।
“কেউ পছন্দ করুক আর না করুক, জেরুজালেমই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী। এটাই চূড়ান্ত। শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য এটা করতে কতদিন লাগবে তা বিষয় নয়, এমনকি শান্তি প্রক্রিয়া না থাকলেও সেটি বিবেচ্য নয়।”
এক প্রশ্নের জবাবে ফিলিস্তিন মিশনের প্রধান জানান, গত বছর বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতির সময়েই মাহমুদ আব্বাস বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ পান।
মাহমুদ আব্বাসের এ সফর আরও সাত মাস আগে হতে পারত জানিয়ে তিনি বলেন, দুই পক্ষের সময় না মেলায় তা আর সম্ভব হয় নি।
“এবার পাকিস্তান থেকে সরাসরি বাংলাদেশে আসছেন তিনি। প্যারিস যাওয়ার পথে এরপর এখান থেকে শুক্রবার জর্ডান যাবেন।”
ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ আল-মালিকি, প্রধান বিচারপতি মাহমুদ আল-হাব্বাস, প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র নাবিল আবু রুদিনেহ, কূটনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মাজদি আল খালিদিসহ সামরিক-বেসামরিক শীর্ষ কর্মকর্তারা এই সফরে মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে থাকবেন।