প্রতিবেদক : বাংলাবান্ধা থেকে টেকনাফ হয়ে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত ৯৮২ কিলোমিটার সড়ক। উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এ রুটকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ইকোনমিক করিডোর হিসেবে চিহ্নিত করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। রুটটি নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় হবে ৫০৩ কোটি ডলার।
এডিবির পর্যালোচনায় আরেক গুরুত্বপূর্ণ ইকোনমিক করিডোর বেনাপোল-যশোর-নড়াইল-ভাটিয়াপাড়া-ভাঙ্গা-মাওয়া-ঢাকা-কাঁচপুর-সরাইল-সিলেট হয়ে তামাবিল পর্যন্ত। ৫০৪ কিলোমিটার দীর্ঘ দক্ষিণপশ্চিম-উত্তরপূর্ব করিডোরটি বাস্তবায়নে মূলধনিসহ আনুষঙ্গিক সম্ভাব্য ব্যয় হবে ৪৮৮ কোটি ডলারের বেশি।
এ দুটিসহ মোট নয়টি অর্থনৈতিক করিডোর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করেছে এডিবি। সংস্থাটির মতে, করিডোরগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে উদ্দীপ্ত করবে। শক্তিশালী করবে দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি। আনুষঙ্গিক মূলধনি ব্যয়সহ এসব করিডোর নির্মাণে মোট মূলধনি ব্যয় হবে ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের বেশি। আনুষঙ্গিক মূলধনি ব্যয় বলতে বোঝানো হয়েছে টোল বুথ, বর্ডার ক্রসিং পয়েন্ট ও স্থলবন্দর এবং ট্রাকবহরের আধুনিকায়ন।
‘কানেকটিং বাংলাদেশ: ইকোনমিক করিডোর নেটওয়ার্ক’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন চলতি মাসে প্রকাশ করেছে এডিবি। ওই প্রতিবেদনেই ইকোনমিক করিডোর-সম্পর্কিত এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবহনভিত্তিক অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপনে বাংলাদেশের সামনে অনেক পথ খোলা রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সরকারি উদ্যোগে এরই মধ্যে ১৬টি ইকোনমিক করিডোর নির্মাণ পরিকল্পনাধীন আছে। এর সবগুলোই গুরুত্বপূর্ণ হলেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ না করলে এর কার্যকারিতা নিয়ে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হবে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে লন্ডনের টিউব ম্যাপের অনুকরণে বাংলাদেশের জন্য নয়টি ইকোনমিক করিডোরের প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি।
প্রস্তাবিত নয়টি অর্থনৈতিক করিডোরের মধ্যে প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে কোনটি আগে বাস্তবায়ন করতে হবে, তাও বলে দিয়েছে এডিবি। অগ্রাধিকারের দিক দিয়ে প্রথমেই রাখা হয়েছে উত্তরপশ্চিম-দক্ষিণপূর্ব করিডোরটি। বাংলাবান্ধা-পঞ্চগড়-রংপুর-বগুড়া-হাটিকুমরুল-বঙ্গবন্ধু সেতু-এলেঙ্গা-টাঙ্গাইল-জয়দেবপুর-ঢাকা উত্তর-ঢাকা দক্ষিণ-কাঁচপুর-মদনপুর-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ হয়ে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত হবে। এ করিডোর নির্মাণে মূল মূলধনি ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৩০ কোটি ৮৯ লাখ ডলার, অন্যান্য মূলধনি ব্যয় যোগ করলে যা দাঁড়াবে প্রায় ৫০৩ কোটি ৯৮ লাখ ডলারে।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নিরিখে বেনাপোল-যশোর-নড়াইল-ভাটিপাড়া-ভাঙ্গা-মাওয়া-ঢাকা-কাঁচপুর-সরাইল-সিলেট-তামাবিল করিডোরকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এডিবি। এ করিডোর বাস্তবায়নে সম্ভাব্য মূল মূলধনি ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৫১ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। অন্যান্য মূলধনি ব্যয় যোগ করলে করিডোরটি নির্মাণে মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৪৮৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
উত্তর-দক্ষিণ (মধ্য) করিডোরটি রাখা হয়েছে অগ্রাধিকারের তালিকায় তৃতীয় স্থানে। ময়মনসিংহ থেকে শুরু হয়ে জয়দেবপুর-ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-বরিশাল হয়ে পটুয়াখালী পর্যন্ত চলে গেছে করিডোরটি। ৩৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ইকোনমিক করিডোরটি বাস্তবায়নে সম্ভাব্য মূলধনি ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২২৯ কোটি ২১ লাখ ডলার। অন্যান্য মূলধনি ব্যয় যোগ করলে মোট ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৩৯৮ কোটি ৯০ লাখ ডলারে।
অগ্রাধিকারের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে থাকা ৮০৫ কিলোমিটার দীর্ঘ উত্তরপশ্চিম-উত্তরপূর্ব করিডোরটি বাংলাবান্ধা-পঞ্চগড়-রংপুর-বগুড়া-হাটিকুমরুল-বঙ্গবন্ধু সেতু-এলেঙ্গা-টাঙ্গাইল-ঢাকা-কাঁচপুর-সরাইল-সিলেট হয়ে তামাবিল পর্যন্ত চলে গেছে। এটি নির্মাণে অন্যান্য আনুষঙ্গিক মূলধনি ব্যয়সহ সম্ভাব্য মূলধনি ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৪৬ কোটি ডলার।
তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ৬৬৮ কিলোমিটার দীর্ঘ উত্তর-দক্ষিণ (পূর্ব) করিডোর। তামাবিল-সিলেট-সরাইল-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-ফেনী-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ হয়ে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত করিডোরটি। এটি নির্মাণে সম্ভাব্য মূলধনি ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫০ কোটি ডলার।
উত্তর-দক্ষিণ (পশ্চিম) করিডোরটি রয়েছে এডিবির অগ্রাধিকার তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে। বাংলাবান্ধা-পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও-রংপুর-বগুড়া-হাটিকুমরুল-বনপাড়া-কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ-যশোর-খুলনা হয়ে মংলা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত ৬৬১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ করিডোর বাস্তবায়নে সম্ভাব্য মূলধনি ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৬৩ কোটি ২৪ লাখ ডলার, অন্যান্য মূলধনি ব্যয়সহ যা দাঁড়াবে ২৫৭ কোটি ২৫ লাখ ডলারে।
এডিবির অগ্রাধিকার তালিকায় সপ্তম স্থানে থাকে করিডোরটি অভ্যন্তরীণ নৌপথভিত্তিক। ৬৭০ কিলোমিটার রুটটি আংটিহারা থেকে খুলনা-বরিশাল-মেঘনার উজান হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। এ ইকোনমিক করিডোরের জন্য মোট মূলধনি ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭০ কোটি ডলার।
অগ্রাধিকারের তালিকায় অষ্টম অবস্থানে থাকা দক্ষিণপশ্চিম-দক্ষিণপূর্ব করিডোরটি দর্শনা-পোড়াদহ-ঈশ্বরদী-জামতৈল-বঙ্গবন্ধু সেতু-জয়দেবপুর-ঢাকা-নরসিংদী-ভৈরব বাজার-আশুগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া-কুমিল্লা-ময়নামতি-লাকসাম-ফেনী-চট্টগ্রাম হয়ে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত চলে গেছে। সড়ক ও রেলপথের সমন্বয়ে ইকোনমিক করিডোরটি বাস্তবায়নে সম্ভাব্য মূলধনি ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫০৪ কোটি ডলার। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নবম স্থানে থাকা ৭৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পূর্ব-পশ্চিম ইকোনমিক করিডোরটি বেনাপোল-যশোর-ঝিনাইদহ-মাগুরা-গোয়ালন্দ ঘাট-পাটুরিয়া ঘাট-মানিকগঞ্জ-ঢাকা-কাঁচপুর-মদনপুর-ময়নামতি-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম হয়ে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি বাস্তবায়নে সম্ভাব্য মূলধনি ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫৬ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের মধ্যে নয়টি করিডোর নিয়ে কাজ চলছে বলে জানান সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক। তিনি বলেন, কোন কাজগুলো আগে করব, সেটা দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়েছে। মূলত যে রুটগুলো দিয়ে আমরা তৃতীয় দেশে যেতে পারব, ইকোনমিক করিডোর নির্মাণে সেগুলোকেই আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি। এর ধারাবাহিকতায় জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত সড়ক চার লেন করার কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। এ সড়কের দুই পাশে সার্ভিস লেনও থাকবে। এলেঙ্গা থেকে রংপুর পর্যন্ত চার লেন প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন। শিগগিরই কাজ শুরু হবে। এটিরও দুই পাশে সার্ভিস লেন থাকবে। এরপর রংপুর থেকে একদিকে বাংলাবান্ধা ও আরেকদিকে বুড়িমারী সড়ক তৈরি হবে। বাংলাবান্ধা দিয়ে নেপাল ও বুড়িমারী দিয়ে ভুটানের সঙ্গে সংযুক্ত হবে বাংলাদেশ। উভয় সড়কই আবার ভারতের মধ্য দিয়ে যাবে, যা আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প।
জানা গেছে, ঢাকা-সিলেট হয়ে ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত রুটটিও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ইকোনমিক করিডোরের তালিকায় রয়েছে, যা নির্মাণে চীনের সঙ্গে জিটুজি চুক্তি করেছে সরকার। আগামী জুন-জুলাইয়ের দিকে এটির কাজ শুরু হওয়ার কথা। অন্যদিকে আখাউড়া হয়ে ভারতের সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টাও চলছে। সেজন্য ভারতের লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় এরই মধ্যে একটি প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। একইভাবে ফেনী হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ভারত-বাংলাদেশ যৌথভাবে ফেনী নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করছে।
এডিবির প্রস্তাবনা অনুযায়ী, প্রস্তাবিত নয়টি করিডোর বাংলাদেশের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সুদৃঢ় করবে। এ নয়টি ইকোনমিক করিডোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার মধ্যে স্থল সেতু হিসেবে ভূমিকা রাখবে বাংলাদেশ।
তবে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা ইকোনমিকের চেয়ে ট্রান্সপোর্ট বা পরিবহন করিডোর নির্মাণে বেশি মনোযোগী বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছে এডিবি। সংস্থাটি বলছে, সরকারের এ উদ্যোগগুলো ইউনিমোডাল বা এক ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়তে সাহায্য করবে। কিন্তু উন্নয়নকে প্রভাবিত করতে এর ভূমিকা হবে সীমিত। সড়ক-রেল-অভ্যন্তরীণ নৌপথকে সমন্বিত করে মাল্টিমোডাল বা বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সমন্বয়ে ইকোনমিক করিডোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে অর্থনৈতিক প্রভাব আরো বিস্তৃত হবে।
ইকোনমিক করিডোর নির্মাণে জমি ব্যবহার পরিকল্পনা নিয়েও প্রতিবেদনে মত প্রকাশ করেছে এডিবি। সংস্থাটির মতে, জমির যৌক্তিক ব্যবহার বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জমির অপব্যবহার, অপরিকল্পিত নগর সম্প্রসারণ ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ব্যবস্থাপনার জন্যই জমির যৌক্তিক ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ।
করিডোর ব্যবস্থাপনাকেও গুরুত্ব দেয়ার সুপারিশ করেছে এডিবি। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশ করিডোর ম্যানেজমেন্ট কর্তৃপক্ষের (বিসিএমএ) মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (বেপজা), হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ— সব সংস্থার সমন্বয়ে একটি কাঠামো তৈরির মাধ্যমে করিডোর ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেয়া হলে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের জন্য তা প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর সঙ্গে করিডোরের সমন্বয় ঘটলে অভ্যন্তরীণ ও অভ্যন্তরীণ বাজারের উপযোগী পণ্য উৎপাদনও সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামসুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, যে সংস্থার পক্ষ থেকেই আসুক, ইকোনমিক করিডোরের প্রস্তাবনাকে আমি স্বাগত জানাই। সরকারকে এ বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনাও দেয়া হয়েছে। ইকোনমিক করিডোর নির্মাণে অবশ্যই সড়ক-রেল-নৌপথ সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থার সমন্বয় ঘটানো জরুরি। বিশেষ করে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর সঙ্গে ইকোনমিক করিডোরের সংযোগ থাকা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে বিনিয়োগের চেয়ে বহুগুণ বেশি সুফল নিয়ে আসা সম্ভব হবে। আর এসব পরিকল্পনা যতটা দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে।