করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ধাক্কা যেভাবে সরকার ‘সামাল দিয়েছিল’ সেভাবেই দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় জোর দিয়ে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সবাইকে মাস্ক পরার পাশাপাশি ঠিকঠাক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ এবং জনসমাগম এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সংসদে শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্য বিধি মানাটা বন্ধ হয়েছে। হিসেব করে দেখেছি, যতগুলি বড় বড় বিয়ের অনুষ্ঠান, বিয়ে বাড়িতে গেছে ফিরে এসে অনেকেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।
“যারা বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে চলে গেছে পর্যটন… কক্সবাজারসহ একই জায়গায় অনেক লোক, সেখান থেকে যারা এসেছেন, তাদের কিন্তু বেশি হয়েছে। এই দাওয়াত-পানি খাওয়া, দোকানপাটে বেশি যাওয়া, ঘোরাঘুরি- এগুলো যেন অতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছিল।”
এখন শুধু বাংলাদেশে না, অনেক দেশেই যে নতুন করে সংক্রমণ বাড়ছে, সে কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, আমি এজন্য সবাইকে বলব, প্রথমে করোনাভাইরাস যখন দেখা দিল তখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম। সেইভাবেই আবার আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
“কিছু নির্দেশনা আমরা দিয়েছি। ধীরে ধীরে চেষ্টা করে যাচ্ছি এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে। কিন্তু সেইক্ষেত্রে জনগণের সহযোগিতা দরকার। আজ কতজন মানুষকে হারালাম। করোনাভাইরাস সম্পর্কে যদি একটু সচেতন থাকতেন তাহলে আর হত না।“
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসে প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর দুই মাসের ‘লকডাউনে’ জনজীবন একপ্রকার অচল ছিল। এরপর সংক্রম কমার সঙ্গে সঙ্গে বিধিনিষেধও ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে দেশে দৈনিক শনাক্তের হার নেমে এসেছিল তিন শতাংশের নিচে। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে আবার সংক্রমণ আবার বাড়ছে দ্রুত গতিতে। বুধবার রেকর্ড ৫ হাজার ৩৫৮ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ৫২ জনের।
এ অবস্থায় আগের মত সবকিছু বন্ধ ঘোষণা না হলেও ইতোমধ্যে ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছে সরকার। সব ধরনের জনসমাগমে লাগাম দেওয়ার পাশাপাশি বেশিরভাগ পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গণ পরিবহনে অর্ধেক যাত্রী বহন এবং অফিস আদালতে অর্ধেক কর্মী নিয়ে কাজ চালানোর নির্দেশনা এসেছে।
তবে ঘরের বাইরে মাস্ক পরা যে সবচেয়ে জরুরি, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সবাইকে অনুরোধ করব মাস্ক পরে রাখতে। এটা নাকের থেকে, সাইনাসে আক্রমণ করে। নাকেই এটা যায়। নাক থেকেই এটা টেস্ট করা হয়। সেক্ষেত্রে সবাইকে মাস্ক পরে থাকতে হবে।“
সংসদে বক্তৃতা করার সময় নিজের মাস্ক খুলে রাখায় বিষয়টিরও ব্যাখ্যা করেন শেখ হাসিনা।
“আমার মাস্ক আছে। বক্তৃতা দেওয়ার জন্য খুলে রেখেছি। আশপাশে কেউ নাই। কেউ যেন মনে না করে মাস্ক না পরেই বলছি। মাস্ক কিন্তু আমার সঙ্গে আছে। মাস্ক পরে কথা বলতে গেলে কথাগুলি পরিষ্কার হয় না। সবাইকে অনুরোধ করব সবাই মাস্ক পরে থাকবেন।
“আর নাকে ভাপ নেওয়া। যখনই কেউ একটু বেশি মানুষের সাথে মিশবেন, দোকানে যাবেন বা অফিসে যাবেন বা মানুষের সাথে কথা বলবেন, ঘরে ফিরে একটু যদি গরম পানির ভাপটা নেওয়া যায়…। এটা খুব কঠিন কাজ না। যে কোনো একটা পাত্র বা জগে বা ছোট একটা বালতিতে ভাপ ওঠা গরম পানির ওপর মুখটা রেখে, দরকার হলে কাপড় দিয়ে মাথাটা ঢেকে ভাপটা নিঃশ্বাসে নিলে পরে ওটা নাকের ভিতের সাইনাস পর্যন্ত…।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে সাইনাসের সমস্যায় ভুগতেন বলে ভাপ নেওয়ার অভ্যাস তার ছিল।
“ভাপটা নিলে পরে জীবাণু নাকের যেখান থেকে পরীক্ষা করার জন্য বের করা হয়, ওই জায়গাটা পৌঁছাবে। ওটাকে দুর্বল করে ফেলবে অথবা শেষ করে ফেলবে।“
শৈশবের স্মৃতি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আরেকটা কাজ আমি নিজে করি। সেটা করতে পারেন। আমি আসার আগে নাকে একটু সর্ষের তেল দেওয়া…, যে কোনো একটা তেল লাগানো…।
“আমি জানি খুব গ্রাম্য একটা ব্যাপার মনে হবে। ছোটবেলায় যখন আমরা পুকুরে গোসল করতে যেতাম, আমার দাদী সবসময় নাকে, কানে আর নাভিতে সর্ষের তেল দিয়ে দিত। নাকে-কানে পানি ঢুকবে না। করোনাভাইরাসের পর থেকে আমি নিয়মিত যখনই বাইরে আসি, নাকে একটু সর্ষের তেল… একেবারে ভিতরে না, নাকের পাশে একটু দিয়ে রাখি। এটাও সবাই দিতে পারেন। ভাপ নেওয়া খুব কাজে লাগে।“
দেশে সংক্রমণ আবার বাড়তে থাকার বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এবারের করোনাভাইরাস হঠাৎ করে খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশেও ২৯, ৩০ এবং ৩১ মার্চ এমন দ্রুত বেড়ে গেছে… যেটা চিন্তাও করা যায় না। আসলে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করেছি বলে মানুষের মাঝে একটা বিশ্বাস জেগে গেছে, যার ফলে ভাবছিল যে কিছুই হবে না। আমি বারবার বলছিলাম, ভ্যাকসিন নিলেও সাবধানে থাকতে হবে।
“মাস্কটা পরে থাকতে হবে। যখনই খুলবেন দ্বিতীয়বার না পরে সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে একটু শুকাতে দেবেন। আরেকটা পরবেন। ছোট একটা বালতি রেখে দিয়েছি। যখনই পরছি জমা করে রেখে দিচ্ছি। ধুয়ে দিচ্ছি, রোদে শুকিয়ে আবার পরছি… কাপড়ের যেটা।”
পাশাপাশি জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “প্রত্যেককে বলব, বিয়ে শাদী কম লোক নিয়ে ঘরোয়াভাবে করা… যেগুলোর তারিখ হয়েছে। বাইরের লোকের সাথে না মেশা। অল্প সময়ের মধ্যে দোকানপাট সেরে কাজ শেষ করে ঘরে ফেরা।
“জনসমাগম যাতে না হয় সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখার জন্য আমি অনুরোধ জানাচ্ছি। মনে হচ্ছিল সবকিছু যেন ঠিক হয়ে গেছে। আমরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণে এনেছিলাম। অর্থনৈতিক কাজগুলোও চলছিল। এখন অফিস আদলতে বলে দিয়েছি, সীমিত লোক নিয়ে কাজ করতে হবে। বেশি মেশামিশি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য দিতে হবে।“